ব্রায়ান মালিকা: জাতিসংঘের রয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য। এখানে পুরো বিশ্ব ২০৩০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য উপযুক্ত কাজ এবং পরিপূর্ণ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা’র ব্যাপারে একমত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত কাজের পরিবেশ বাতলে দিতে এসডিজি যখন ব্যর্থ হয়, তখন সাফল্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়ল। কেননা সারা পৃথিবীতে প্রতিবন্ধীরা কর্মসংস্থানে গিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, কিন্তু এখানে কোনো অনন্য ও শক্তিশালী কর্মপরিকল্পনা দেখানো হলো না।
কর্মসংস্থানের মানে এই নয় যে সেখান থেকে কেবল আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। এখানে থাকতে হয় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সামাজিক অবস্থান ও আত্মসম্মান। আর এগুলো নিশ্চয় একজন কর্মীর সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে প্রতিবন্ধীদের জন্য এসব সুবিধা খুবই মূল্যবান। তবে প্রতিবন্ধীরাই এসব সুবিধা পেতে সবচেয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হয়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের নেতৃত্ব পুরো বিশ্ব ২০৩০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য উপযুক্ত কাজ এবং পরিপূর্ণ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানকে এগিয়ে নেওয়া’র ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এখানে কেনিয়ার মতো একটি ছোট রাষ্ট্রের উদাহরণ আসতে পারে। রাষ্ট্রটিতে ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২১ শতাংশ। রাষ্ট্রটির প্রগতি এখন অপরিহার্য। বিশেষ করে ক্রমবর্ধিষ্ণু তরুণ প্রজš§কে একটি জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশে রূপান্তর করার বিকল্প এখানে নেই। তবে এই এসডিজি কর্মসূচি এই সংকটের কোনো ভালো সমাধান দেখাতে পারেনি। ব্যতিক্রম ও শক্তিশালী কিছু উপস্থাপন করতে না পারলে এই চ্যালেঞ্জ অর্জন সফল হবে না। বিশেষ করে প্রতিবন্ধীদের চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি কঠিন। উন্নত দেশে কর্মক্ষম প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ৫০-৭০ শতাংশই দিনাতিপাত করছে কর্মহীন অবস্থায়। যুক্তরাজ্যে ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের বিপরীতে চাকরির প্রতিযোগিতায় প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীরা ৬০ শতাংশ বেশি দরখাস্ত জমা দিয়েছে। সাধারণ প্রার্থী ও প্রতিবন্ধী প্রার্থী মিলে যত জনকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হলো, সে সংখ্যাটি মোট দরখাস্তের ৫১ শতাংশ। এই ৫১ শতাংশের মধ্যে প্রতিবন্ধী রয়েছে ৬৯ শতাংশ। এমনকি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে শ্রমবাজার আরও শোচনীয়। সেখানে প্রতিবন্ধীদের অবস্থা নিদারুণ। ওই দেশগুলোতে প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই বেকার। এক্ষেত্রে ভারতের কথায় আসা যাক, এখানে সাত কোটি লোক প্রতিবন্ধী; কিন্তু তার মধ্যে মাত্র এক লাখ প্রচলিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। এটাকে এক ধরনের বৈষম্য বলতে হবে, কেননা অনেকেই মনে করে থাকেন প্রতিবন্ধীরা কম উৎপাদন সক্ষমশীল। তাছাড়া তারা এটাও চিন্তা করেন যে, প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে কাজ করতে সাধারণ কর্মীরা বিরক্ত হয়। জনসাধারণের মধ্যে সবার জন্য কাজ নিশ্চিত করতে এসব প্রতিষ্ঠানই মূলত বৈষম্য সৃষ্টি করে। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালক মনে করেন, প্রতিবন্ধীদের পরিচালনা খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে কেনিয়ার চিত্রও এখানে প্রাসঙ্গিক। সেখানে প্রতিবন্ধীদের চাকরিদানে বিভিন্ন কোম্পানির ওপর আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের শ্রমবাজারে প্রবেশের অনেক আগেই বাধা সৃষ্টি করা হয়। কেনিয়ায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ভলান্টারি সার্ভিসেস অভার্সিস’-এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কেনিয়ায় প্রতিবন্ধীরা চাকরির বাজারের সাধারণ যোগ্যতাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে থাকে। ফলে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আগেই তারা আবেদনে অযোগ্য হয়ে যায়। এর পেছনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন তারা সহজে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারে না এবং চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। কার্যত প্রতিবন্ধীদের প্রবেশযোগ্য গ্রন্থাগার ও প্রশিক্ষণের ব্যাপক অভাব রয়েছে। এখানে ১০৫ শিশুশিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র এক শিক্ষক। এ তুলনায় ৩৫ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর বিপরীতে এক শিক্ষার্থী রয়েছে। তাছাড়া এখানে বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপারে অবহেলা রয়েছে। এমনকি শিক্ষা যা আছে তার মানও খুব নিম্ন।
তবে কিছু প্রতিবন্ধী প্রযুক্তিগত শিক্ষায় বেশ দক্ষ। তারা চাকরির পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে ভালোভাবে লড়তে সক্ষম। কিন্তু প্রযুক্তির পাশাপাশি আরও যেসব যোগ্যতা প্রয়োজন হয়, সেগুলো অর্জনে তারা দারুণভাবে পিছিয়ে রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের পর তারা যোগাযোগে দক্ষতা অর্জনের কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে বেকারই থাকছে।
কল্পনা করুন এক ১৯ বছর বয়সি কেনিয়ান প্রতিবন্ধী নারী প্রকট উদ্বিগ্নতা ব্যাধিতে ভুগছেন। তিনি হন্যে হয়ে একটি চাকরি খুঁজছেন। তার কোডিং ও টাইপিংয়ে ভালো দখল রয়েছে। কিন্তু চাকরির সাক্ষাৎকারে তিনি কখনোই ভালো করতে পারছেন না। ফলে তিনি তার যোগ্যতাকে কোনোভাবেই বিক্রি করতে পারছেন না। দিনে দিনে তার সুযোগগুলো দমে যাচ্ছে। তাই প্রতিবন্ধীদের চাকরির বাজারকে উন্নত করতে কেবল মানসম্পন্ন শিক্ষা দিলেই হবে না, সেইসঙ্গে তাদের আরও কিছু প্রাথমিক যোগ্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যা তার দক্ষতাকে পরিপূর্ণ করবে। যেমন তাদের চাকরির পরীক্ষায় ভালো করার কোচিং করানো অপরিহার্য। চাকরির কোচিং প্রতিবন্ধীদের নিজস্ব যোগ্যতা, সক্ষমতা, চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুধাবনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। এমনকি চাকরিদাতার সঙ্গে তার একটি বোঝাপড়া করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। চাকরিদাতা তাদের একজন দক্ষ ও প্রত্যয়ী প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। এভাবে প্রতিবন্ধীরা তাদের চাকরির সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় একটি সহায়ক শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। তাতে সে চাকরিটি পেয়ে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে এবং তার সেরা নৈপুণ্যই সে প্রদর্শন করে। যে কোম্পানিতে প্রতিবন্ধীরা তাদের যোগ্যতা দেখানোর সুযোগ পেয়েছে, সে কোম্পানি অনুধাবন করতে পেরেছে প্রতিবন্ধী একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়, আবার অতিরিক্ত খরচের কারণও নয়। যেসব চাকরি সমঝতার ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ দায়িত্ব, বেতন, কর্মঘণ্টা ও মেয়াদ চুক্তিভিত্তিতে নির্ধারণ হয়, সেসব চাকরিতে চাকরির প্রশিক্ষকরা কর্মী ও মালিকের মধ্যকার সম্পর্ক স্থির করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে চাকরিদাতা ও কর্মীর উভয়ের চাহিদা ও জোগান মিটমাট হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেই ১৯ বছর বয়সি প্রতিবন্ধী নারী এভাবেই তার বাড়িতে বসেই কাজের সর্বোচ্চ নৈপুণ্য দেখাতে পারে। কেননা কাজ বা দায়িত্ব অনলাইননির্ভর হওয়ায় সব কাজই তার সাধ্যের মধ্যে থাকবে। তবে কোম্পানি যদি তাকে তার উপযুক্ত কাজের পরিবেশ না করে দেয়, তবে বিপত্তি তৈরি হয়। কার্যত প্রতিবন্ধী নারীর জন্য কোম্পানি তার বাসায় একটি ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ দিতে পারত। কিন্তু যখন কোম্পানি এ ব্যবস্থা করতে পারে না, তখনই কোম্পানি ও কর্মীর মধ্যে সংকট দানা বাঁধে। কর্মীর চাকরিতে সন্তুষ্টি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে কোম্পানি ও কর্মীর মধ্যকার সমঝোতা আনায় চাকরির প্রশিক্ষকেরা একটি ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থাৎ চুক্তির ন্যায্যতা সৃষ্টিতে তারা উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করবে। কীভাবে কোম্পানির অর্থ সাশ্রয়ী হবে এবং একই সঙ্গে কর্মীদের সন্তুষ্টি ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে ভাববে। চুক্তিতে তা প্রতিফলিত হবে। চুক্তিভিত্তিক চাকরিদাতা কোম্পানি কর্মী ও কোম্পানি এবং প্রতিবন্ধী কর্মী ও সহকর্মীর মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। একটি কোম্পানির প্রতিবন্ধী কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তার স্কুল, তার কর্মস্থল ও নীতিনির্ধারকের মতো সর্বস্তরের স্টেকহোল্ডাররের সহযোগিতার বিকল্প নেই। এসব ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিশ্রুতিশীল দায়িত্ব পালনের মধ্যেই এর সমাধান রয়েছে। কিন্তু এসডিজি-৮-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অবশ্যই এখনই কাজ শুরু করতে হবে পরিকল্পিত উপায়ে। কেনিয়ার এই কাঠিন্য সব জায়গার উদাহরণ হতে পারে। বস্তুত শুরু করার এখনই সময়।
সমাজকর্মী, প্রজনন-স্বাস্থ্য পরামর্শক
প্রতিষ্ঠাতা, ওয়ান মোর পার্সেন্ট (তরুণী ও বালিকা স্বাস্থ্য উন্নয়ন সংস্থা)
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে
ভাষান্তর: মিজানুর রহমান শেলী