Print Date & Time : 12 September 2025 Friday 4:03 am

প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন ফাইন্যান্স কর্মকর্তা

একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়।

খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেডের ফাইন্যান্স অ্যান্ড কন্ট্রোলিং হেড ও কোম্পানি সেক্রেটারি মুহাম্মদ মশিউর রহমান এফসিএ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস

মুহাম্মদ মশিউর রহমান এফসিএ সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেডের ফাইন্যান্স অ্যান্ড কন্ট্রোলিং হেড ও কোম্পানি সেক্রেটারি। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে সম্পন্ন করেছেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি ও চার্টার্ড সেক্রেটারি পেশাগত ডিগ্রি। তিনি দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) একজন সম্মানিত ফেলো

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই।

মুহাম্মদ মশিউর রহমান: ক্যারিয়ার শুরু করি ২০০০ সালে উদ্দীপনে (ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস ফর প্রোগ্রামড অ্যাকশন) ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে। পরে একই প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি পেয়ে ফাইন্যান্স ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের কোঅরডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এরপর ২০০৫ সালে ম্যাক্সওয়েল স্টাম্প লিমিটেডে সিনিয়র অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর ওই বছর সিনজেনটাতে যোগ দিই ফাইন্যান্সিয়াল কন্ট্রোলার হিসেবে। একই প্রতিষ্ঠানে ২০০৭ সালে ফাইন্যান্স ডিরেক্টর ও কোম্পানি সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাই। তারপর ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী সিনজেনটার ইন্টারনাল রিঅরগানাইজেশন হয়। তখন ফাইন্যান্স ডিরেক্টর ও কোম্পানি সচিব নাম পরিবর্তন করে ফাইন্যান্স অ্যান্ড কন্ট্রোলিং হেড ও কোম্পানি সেক্রেটারি করা হয়।

শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে ফাইন্যান্সকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?

মশিউর রহমান: ক্যারিয়ার গড়ার পরিকল্পনা করতে গিয়ে লক্ষ করি, আমার বন্ধুরা যেসব পেশাকে বেছে নিয়েছে তার চেয়ে ফাইন্যান্স পেশায় চ্যালেঞ্জ বেশি। এ পেশায় উন্নতি করার সুযোগ আছে। তাছাড়া পেশাটি বেশ আকর্ষণীয়। এ পেশায় একাডেমিক ও পেশাগত শিক্ষা দুটোকেই প্রয়োগ করার চমৎকার সুযোগ আছে।

শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ ফাইন্যান্স কর্মকর্তার ভূমিকা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বলুন।

মশিউর রহমান: একটা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গঠন লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পরেই প্রধান অর্থ কর্মকর্তার অবস্থান। এ অবস্থান দেখেই বোঝা যায়, প্রতিষ্ঠানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন প্রধান অর্থ কর্মকর্তা। প্রধান অর্থ কর্মকর্তার স্টেটিউটরি দায়িত্ব যেমনÑবুকস অব অ্যাকাউন্টস রক্ষণাবেক্ষণ করা, কমপ্লায়েন্স কমপ্লাই করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কলাকৌশলগত দিকনির্দেশনা দেওয়া। প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছে কি না, তা দেখভাল করেন ও এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন তিনি। আরেকটি বড় ভূমিকা হলো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল আইনকানুন মেনে প্রতিষ্ঠান চলছে কি না, তা নিশ্চিত করা। তাছাড়া প্রধান অর্থ কর্মকর্তাই প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তগুলো প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক কি না, তা প্রকাশ করেন। প্রতিষ্ঠানের লাভজনক ও টেকসই উন্নয়নের ক্রমবৃদ্ধি নিশ্চিত করেন একজন ফাইন্যান্স কর্মকর্তা।

শেয়ার বিজ: ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) প্রতিষ্ঠানের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে?

মশিউর রহমান: আমি মনে করি, এটা একটা ভালো উদ্যোগ। যদিও অনেকের নানা মত রয়েছে এটা নিয়ে। কেউ কেউ এই অ্যাক্টের পক্ষে। আবার অনেকে মনে করেন, এটা ফাইন্যান্স পেশার ক্ষতি করবে। অবশ্য তাদের আশঙ্কার অনেক কারণও আছে। কিন্তু আমি মনে করি, একটি প্রতিষ্ঠান তার ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট প্রকাশ করে ইনভেস্টর, শেয়ারহোল্ডার ও স্টেকহোল্ডারদের জন্য। যদি এখানে স্বচ্ছতা না থাকে তাহলে বিনিয়োগকারী বা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। এফআরএ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এসব তথ্যে আরও স্বচ্ছতা আসবে ও স্টেকহোল্ডারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে আমি করি। তবে এটা নিয়ে আশঙ্কা, অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হলে কিংবা সার্ভিস দেওয়ার পরিবর্তে পেশাজীবীদের ঘাড়ে ঝামেলা চেপে বসলে বিষয়টি অনেক খারাপ হবে। অ্যাক্টটি বাস্তবায়নে সরকারকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

শেয়ার বিজ: বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি সিএ ফার্মের সহযোগিতা নেওয়ার প্রবণতা বেশি কেন?

মশিউর রহমান: প্রথম কারণ হলো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক মানের অডিট ফার্মের সহযোগিতা নেয়। বিভিন্ন দেশে এসব অডিট ফার্মের শাখা রয়েছে। সংগত কারণে এমন ফার্মের মাধ্যমে সব দেশে অডিটের কাজ করা হলে কোঅরডিনেশন সুন্দর হয়। অডিটও ইফেকটিভ হয়। দ্বিতীয় কারণ হলো বিশ্বের বড় যে ফার্মগুলো, যেমন কেপিএমজি, আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়ং, ডেলোটি এবং পিডব্লিউসির ওপর বিনিয়োগকারীরা ও শেয়ারহোল্ডাররা বেশি আস্থাশীল। যদিও আমাদের দেশি ফার্মগুলো অনেক ভালো কাজ করে।

 শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের করনীতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

মশিউর রহমান: করনীতি একটি জটিল বিষয়। প্রতিবছর এ নীতিতে নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের মেয়াদে বেশকিছু ভালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। এর মধ্যে অন্যতম অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এটি করার ফলে করদাতার হয়রানি অনেকাংশে লাঘব হয়েছে। এছাড়া আয়কর মেলায় রিটার্ন জমা দেওয়া ও কর পরিশোধের ব্যবস্থা করা ভালো উদ্যোগ। আগে করদাতা শনাক্তরণ সংখ্যা (টিআইএন) প্রাপ্তির জন্য আয়কর অফিসে ধরনা দেওয়া লাগতো। এখন আর তা করা লাগে না। ঘরে বসে অনলাইনে ই-টিআইএন নম্বর পাওয়া যায়।

তবে কর প্রশাসনের কিছু কাজ এখনও ব্যবসাবান্ধব নয়। ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্টের ক্ষেত্রে অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিয়ে কর দিতে গেলে কর কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো কর চাপিয়ে দিতে চায়, বাস্তবতা বুঝতে চায় না। অনেক সময় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের গ্রস প্রফিট তারা নির্ধারণ করেন। একটা প্রতিষ্ঠানের গ্রস প্রফিট ‘বুকস অব অ্যাকাউন্টস’ দ্বারা নির্ধারিত হয়। কর কর্তৃপক্ষ কেন প্রতিষ্ঠানের গ্রস প্রফিট নির্ধারণ করবে? এমন ধরনের অনেক সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক। কর দিতে গিয়ে ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না। নানা কারণে ফাইনাল অ্যাসেসমেন্ট সঠিক সময়ে হয় না, যা ব্যবসার জন্য খারাপ। সরকারকে এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। কর প্রশাসনকে আরও ফ্রেন্ডলি হওয়া উচিত।

শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে একই সঙ্গে কোম্পানি সচিব ও ফাইন্যান্স কর্মকর্তা কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

মশিউর রহমান: অনেক ক্ষেত্রে দুটি পেশার কাজের মিল থাকে। যেমনÑদুটি পেশারই বড় একটা ভূমিকা হলো কমপ্লায়েন্স কমপ্লাই করে প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করা। একজন সিএফও স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল আইন নিশ্চিত করেন। একইভাবে কোম্পানি সচিবও নানা নিয়মকানুন, সিকিউরিটিজ বা রেগুলেটরি আইন মেনে চলতে সাহায্য করেন। সিএফও ফাইন্যান্সিয়াল দিকনির্দেশনা দেন, কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সি নিশ্চিত করেন, ফাইন্যান্সিয়াল সাসটেইনিবিলিটিও নিশ্চিত করেন। কোম্পানি সচিব প্রতিষ্ঠানকে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে দাঁড় করানোর জন্য কমপ্লায়েন্সগুলো নিশ্চিত করেন। ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করেন। যোগাযোগ রক্ষা করেন। সুতরাং দুটি পেশার ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব রয়েছে। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকে, যা সাধারণ পাবলিক লিমিটেড বা প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠানে থাকে না। যে কারণে এখানে একইসঙ্গে দুটি ভূমিকায় কাজ করা সহজ। আমি এখানে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ দেখি না।

শেয়ার বিজ: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

মশিউর রহমান: প্রত্যেকেরই যেন একটি ক্যারিয়ার প্ল্যান থাকে। যদি কেউ প্ল্যান ছাড়া এগোয় তবে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। শুরুতে পরিকল্পনা থাকলে চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে সুবিধা হয়। যে পেশায়ই ক্যারিয়ার গড়েন না কেন, ক্যারিয়ার প্ল্যান সঠিক হওয়া জরুরি। পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। পরিশ্রমী হতে হবে।

 শেয়ার বিজ: সফল ফাইন্যান্স কর্মকর্তা হতে হলে আপনার পরামর্শ কী?

মশিউর রহমান: শুধু ফাইন্যান্স বা কোম্পানি সচিব নয়, যে কোনো পেশাতেই আপডেট থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন আইন-কানুন, প্রযুক্তি ও পদ্ধতি খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, আর এ পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো জরুরি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। পক্ষপাতহীনভাবে সেবা দিতে হবে। সৎ হতে হবে।