রহমত রহমান: দুলহান কেশ কালা। এক ধরনের তেল। প্রতি কেজি শুল্ককরসহ প্রায় ৭৫৬ টাকায় আমদানি হয়। বাজার যাচাইয়ে দেখা গেছে কেজি হিসেবে আমদানি হওয়া এই তেল বিক্রি হয় মিলি হিসাবে। প্রতি ১০০ মিলি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়। সে হিসাবে প্রতি কেজির বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার ৫০০ টাকার বেশি। যে তেল ৭৫৬ টাকায় আমদানি হয়, সে তেল কীভাবে বাজারে দুই হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়! আমদানি মূল্যের সঙ্গে বাজারমূল্যের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। অথচ বাড়তি টাকার ওপর সরকার কোনো রাজস্বই পায় না।
এখানেই শেষ নয়, প্রসাধনী হিসাবে এই তেলের ন্যূনতম ভ্যালু চার ডলার নির্ধারণ করা রয়েছে। অথচ কোনো কাস্টম হাউস বা স্টেশন তা মানেন না। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে প্রতি কেজি দুই ডলার ২০ সেন্ট ও পানগাঁও কাস্টম হাউস দিয়ে দুই ডলার ৬৫ সেন্টে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। বেনাপোল কাস্টম হাউস প্রতি কেজি তিন ডলারে শুল্কায়ন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি বাজার যাচাইয়ের নামে করা একটি কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ডলার থেকে কমিয়ে দুই ডলার ৪৩ সেন্টে শুল্কায়ন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেটি প্রসাধনী, আবার ন্যূনতম ভ্যালু নির্ধারণ করা আছেÑসেটি বেনাপোল কাস্টম হাউস কমায় কীভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভ্যালু কমানোর কারণে প্রতি টনে প্রায় এক লাখ টাকা আর প্রতি চালানে কয়েক লাখ টাকা রাজস্ব হারাবে সরকার। শুল্ক গোয়েন্দা এর আগে বিষয়টি জানিয়ে সব কাস্টম হাউসকে চিঠি দিলেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, দুলহান কেশ কালা নামের পণ্যটি বিভিন্ন কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন মূল্যে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু শুল্কায়নযোগ্য মূল্য আর বাজারমূল্যের সঙ্গে বেশ পার্থক্য পায় কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। বিষয়টি জানিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনারকে ৩১ অক্টোবর চিঠি দেয়া হয়। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. বশীর আহমেদের সই করা চিঠিতে বলা হয়, ঢাকার চকবাজার এলাকার আমদানিকারক মেসার্স রেড রোজ ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটি দুলহান কেশ কালা নামের পণ্যটি বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন মূল্যে আমদানিপূর্বক শুল্কায়ন করছে। যেমন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে দুই দশমিক ২০ ডলার, পানগাঁও কাস্টম হাউস দিয়ে দুই দশমিক ৬৫ ডলার ও বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে তিন ডলারে শুল্কায়ন করা হয়েছে। ‘শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা, ২০০০’ অনুযায়ী পণ্যটির যৌক্তিক ও যথাযথ মূল্যে শুল্কায়ন নিশ্চিতকরণের জন্য সব কাস্টম হাউসকে অনুরোধ জানানো হয়।
এ বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, প্রসাধনী সামগ্রী দুলহান কেশ কালা। এটির ন্যূনতম ভ্যালু চার ডলার নির্ধারণ করা আছে। বেনাপোল, চট্টগ্রাম, পানগাঁও কাস্টম হাউস দিয়ে তিন ডলারের কম মূল্যে শুল্কায়ন হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর চিঠি দিয়ে সব কাস্টম হাউসকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যেটি প্রসাধনী, আবার ন্যূনতম ভ্যালু নির্ধারণ করা আছে, সেটি বেনাপোল কাস্টম হাউস কমায় কীভাবে বলে প্রশ্ন করেন তিনি। বিষয়টি এনবিআরকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।
শুল্কায়নযোগ্য মূল্য আর বাজারমূল্যের পার্থক্যের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, বেনাপোল দিয়ে ভারত থেকে সড়কপথে আমদানি হয়। এতে আমদানি খরচ কম হওয়ার কথা। চট্টগ্রামে জাহাজ দিয়ে আমদানি হলে খরচ আরও কম হওয়ার কথা। পানগাঁও দিয়ে আমদানি হলে কিছুটা বেশি হবে। কিন্তু এক কেজি ৭৫৬ টাকায় আমদানি হয়। খরচ আর লাভ যোগ করলে এক হাজার টাকা হতে পারে। কোনোভাবেই তা আড়াই হাজার বা তার বেশি বিক্রি হতে পারে না। বাড়তি বিক্রি থেকে সরকার কোনো রাজস্বই পায় না। তাহলে কীসের বাজার যাচাই হলো?
অপরদিকে মেসার্স এসবি ডিস্ট্রিবিউশন নামীয় প্রতিষ্ঠান দুই ডলারে শুল্কায়নের জন্য ২০ নভেম্বর বেনাপোল কাস্টম হাউসে আবেদন করে। আবেদনের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও পানগাঁও কাস্টম হাউস দিয়ে দুই দশমিক ২০ ডলারে অন্য আমদানিকারক পণ্যটি খালাস নিচ্ছে বলে প্রমাণাদি দেয়া হয়। বেনাপোল কাস্টম হাউস এসব প্রমাণ যাচাই করে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি বাজার যাচাই করে ২৩ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন দেয়, যাতে দুই দশমিক ৪৩ ডলারে শুল্কায়িত মূল্য নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয়, যা কমিশনার অনুমোদন দেয়। ঢাকার আমদানিকারক এসবি ডিস্ট্রিবিউশনের ভারত থেকে আমদানি করা দুলহান কেশ কালারের একটি চালান ১৪ নভেম্বর শুল্কায়ন করা হয়েছে। নিট ওজন সাত হাজার ৯২০ কেজি ও গ্রস ২৩ হাজার ৯৮০ কেজির চালানটির ইনভয়েস মূল্য দেখানো হয় ১৫ হাজার ৮৪০ ডলার। এই চালানটিও কম মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়েছে। চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিলেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স সিনসিয়ার ইন্টারন্যাশনাল।
এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তরিকুল বরশা শেয়ার বিজকে বলেন, বেনাপোল কাস্টম হাউস দারাজসহ অন্যান্য অনলাইন দেখে জোর করে দুই দশমিক ৪৩ ডলার করে দিয়েছে। আগে দুই দশমিক ২০ ও দুই দশমিক ৭০ ডলারে অন্যান্য স্টেশন হাউস দিয়ে শুল্কায়ন হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা আপত্তি দেয়ার পর দুই দশমিক ৪৩ ডলার করেছে। কেজি হিসাবে নেয়া হলেও প্রতি ১০০ গ্রাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাহলে কীভাবে এত কমে শুল্কায়ন হচ্ছেÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এত দাম নয়। যশোর-খুলনার শোরুম ও দোকানে ফোন করে দেখেন। ৭০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়।
অপরদিকে বেনাপোল কাস্টম হাউসের একটি সূত্র জানিয়েছে, বেনাপোল কাস্টম হাউস তিন ডলার করে শুল্কায়ন করা হয়েছে। কয়েকটি আমদানিকারক তিন ডলারের নিচে শুল্কায়ন করতে বহু চেষ্টা-তদবির করেছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শেষে কাস্টমস গোয়েন্দা চিঠি দেয়ার পর হাউস বাজার যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি গঠন করেই আমদানিকারকদের অদৃশ্য কারণে খুশি করে দিল। এক আমদানিকারক প্রতি মাসে এই হাউস দিয়ে অন্তত দুবার এই তেল আমদানি করেন। শুল্কায়িত মূল্য কমানোর ফলে প্রতি মেট্রিক টনে অন্তত এক লাখ এবং প্রতি চালানে অন্তত ৪০-৪৫ লাখ টাকার রাজস্ব হারাবে সরকার।
অপরদিকে চট্টগ্রাম, পানগাঁওসহ অন্যান্য কাস্টম হাউস স্টেশনে শুল্কায়িত মূল্য আরও কম বলে জানিয়েছেন বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) মো. আবদুল হাকিম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বুড়িমারী স্টেশনে বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে পর্যন্ত গিয়েছেন। আমাদের যা প্রস্তাব করেছে, তা অন্যান্য স্টেশনের চেয়েও বেশি।
এনবিআর সূত্রমতে, ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আমদানিকৃত পণ্যের এইচএস কোড নির্ধারণের বিষয়ে এনবিআরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বিভিন্ন কাস্টম হাউস অগ্রিম রুলিংয়ের বিষয়ে মতামত চেয়ে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে মতামত দেয়া হয়েছে। বেনাপোল কাস্টম হাউস এইচএস কোড-৩৩০৫.৯০.০০-তে আমদানি করা পণ্যের শ্রেণিবিন্যাস পূর্বক কেজিপ্রতি ন্যূনতম শুল্কায়নের বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি দেয়। সভায় এইচএস কোড-৩৩০৫.৯০.০০-তে প্রতি কেজি ন্যূনতম চার ডলারে শুল্কায়ন করার বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে। প্রসাধনী হিসেবে এই তেলের ন্যূনতম চার ডলার নির্ধারণ করাই আছে। এছাড়া এর সঙ্গে যোগ হবে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, পাঁচ শতাংশ অগ্রিম কর, পাঁচ শতাংশ আগাম কর, ২০ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটিসহ মোট শুল্ককর ১৮৩ দশমিক চার শতাংশ।