সুনীল অর্থনীতির সুবিধা গ্রহণ

প্রধান চ্যালেঞ্জ উপাত্তের ঘাটতি ও বিনিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় বিশাল জলরাশি রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা প্রায় এক লাখ ৪৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। কিন্তু এ বিপুল আয়তনের সমুদ্র থেকে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করা সম্ভব, তার অধিকাংশই এখনও বাংলাদেশ আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ এ বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য যেসব ক্ষেত্রে উপাত্ত প্রয়োজন, তার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। যে বিনিয়োগ সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তি খাত এখনও সুনীল অর্থনীতি বা সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতকে আগ্রহী করে তুলতে নানা উদ্যোগ প্রয়োজন।

খুলনার স্থানীয় একটি হোটেলে গতকাল ‘স্থানীয় নাগরিকদের কণ্ঠস্বর: বাংলাদেশে টেকসই সুনীল অর্থনীতির জন্য বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক আঞ্চলিক পরামর্শ সভায় এসব বিষয় উঠে আসে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্তনীতি বিভাগ (জিইডি), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী এ পরামর্শ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বায়ক জুয়েনা আজিজ।

জিইসি সদস্য (সচিব) ড. কাউসার আহাম্মদের সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কিউ এম মাহবুব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম খালেদ ইকবাল, পিএইচপি ফ্যামিলির প্রতিষ্ঠাতা সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাইদ মোহাম্মদ বেলাল হায়দার, ইউএনডিপি বাংলাদেশের উপ-আবাসিক প্রতিনিধি ভ্যান গোয়েন প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা ফখরুল আহসান। অনুষ্ঠানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।

ড. কাউসার আহাম্মদ বলেন, ‘সুনীল অর্থনীতিতে দুই ধরনের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। একটি হচ্ছে ঋণের মাধ্যমে, অন্যটি ইকুইটি বিনিয়োগের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সুকুক বন্ড একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। এ বন্ডের প্রতি মানুষের বেশ আগ্রহ রয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে সুনীল অর্থনীতিতে অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘ব্লু বন্ড’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্লু বন্ড চালুর করার বিষয়ে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এ বিষয়ে কাজ করছে। এছাড়া সুনীল অর্থনীতির কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি স্বতন্ত্র উইং চালু করার বিষয়টিও চলমান।’

বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের গুরুত্বের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সুনীল অর্থনীতি থাকে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা আহরণের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে

আমাদের দেশে পিপিপি মডেল এখনও বিনিয়োগকারীদের কাছে তেমন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। এ বিষয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে উপাত্তের (ডেটা) ঘাটতি একটি বড় বাধা। এ বাধা দূর করতে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সৃষ্টির জন্য গবেষণা ও জরিপ পরিচালনা করা আবশ্যক। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’

অনলাইনে যুক্ত হয়ে ভ্যান গোয়েন জানান, সুনীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জন্য ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্সিং বা মিশ্র অর্থায়ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এছাড়া অর্থ সংগ্রহ ব্লু বন্ডও কার্যকর অবদান রাখবে। এক্ষেত্রে আগে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনার জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে।

জুয়েনা আজিজ বলেন, ‘যেকোনো নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই এ পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়েছে। এখান থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন মতামত সুনীল অর্থনীতি বিষয়ে বিভিন্ন নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’ তিনি বলেন, আপৎকালীন ভিত্তিতে সমুদ্র সম্পদ আহরণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরীক্ষিত জ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে। এর পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হতে হলে যে হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন, তা অর্জন করতে হলে আমাদের অবশ্যই সুনীল অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে হবে।

মূল প্রবন্ধে ফখরুল আহসান বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অর্জনে ২০১৭ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার তুলনায় প্রায় ৯২৮ বিলিয়ন ডলার বাড়তি অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। আর এ অর্থায়ন ৮৫ শতাংশই স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই বেসরকারি খাত থেকে সংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে যে অর্থ প্রয়োজন হবে, তা আহরণের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে সুনীল অর্থনীতি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ নিশ্চিত হয়নি। তিনি বলেন, ওইসিডিভুক্ত দেশগুলো থেকে যে পরিমাণ অর্থ সহায়তা পাওয়ার কথা আমরা তা পাচ্ছি না। সেখান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

সাইদ মোহাম্মদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। এ জন্য সাগর সম্পর্কে আমাদের নাগরিকদের সচেতন করা ও এ সংক্রান্ত জ্ঞান সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। মানুষকে সমুদ্র সংক্রান্ত জ্ঞানে দিক্ষিত করে তুলতে হবে। এ জন্য পাঠ্যপুস্তকে সমুদ্রবিষক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন, এক লাখ ৪৮ হাজার সমুদ্রসীমার মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটারের পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত আছে। বাকি বিশাল এলাকার উপাত্ত পেতে হলে ব্যাপক মাত্রায় গবেষণা ও জরিপ পরিচালনা করতে হবে।’ এক্ষেত্রে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানে বক্তারা সুনীল অর্থনীতির সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্যাপক মাত্রায় গবেষণা পরিচালনা, বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা ও আইনি সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণে উদ্যোগ গ্রহণ, পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ, দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে উদ্যোগ নেয়া, সমুদ্র দূষণ প্রতিরোধ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা, সমুদ থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি আহরণে উদ্যোগ গ্রহণ, ইকো টুরিজম জোরদারকরণ, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ইত্যাদি।