শেখ আবু তালেব: করোনাকালে প্রবাসী কর্মীদের যাওয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের তালিকায় থাকা অধিকাংশ দেশে। কয়েকটি দেশে রয়েছে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। সীমিত পরিসরে কিছু দেশ খুললেও সেখান থেকে রেমিট্যান্স আসছে কম। এমন অবস্থায় বরাবরের মতো রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রেখেছে সৌদি আরবের শ্রমবাজার। এখনও মোট রেমিট্যান্সের সিংহভাগ জোগান দিচ্ছে দেশটিতে যাওয়া বাংলাদেশি প্রবাসীরা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ’২১) দেশ থেকে প্রবাসে কর্মী হিসেবে গেছেন ৭৩ হাজার ৯৯২। এর মধ্যে নারী কর্মীই ১৩ হাজার ৪০৩ জন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে গেছেন ৫৭ হাজার ৪৩৯ জন, যা মোট প্রবাসী কর্মীর সিংহভাগ বা ৭৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
একইসঙ্গে সৌদি আরব থেকে এসময় রেমিট্যান্স এসেছে ১৩০ কোটি ৪১ লাখ ডলার, যা মোট আসা রেমিট্যান্সের ২৪ দশমিক ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এমন তথ্য।
জানা গেছে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বৈদেশিক দায় তথা আমদানি ব্যয় পরিশোধে ৪১ শতাংশ অবদান রাখে রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেই সচল রয়েছে গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পূর্বের প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে গিয়েছিলেন ৯৬ হাজার ৯১২ জন। আগের চেয়ে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর ’২১ প্রান্তিকে প্রবাস যাওয়ার সংখ্যা কমেছে ২৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর ফলে কমে এসেছে রেমিট্যান্সও।
প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ গত বছরের আলোচিত সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন দায়ী করছে করোনা মহামারির প্রভাবকে। করোনা মহামারির প্রভাবে সৌদি আরবে প্রবাসীদের যাওয়ার সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমেছে। একইসঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে রেমিট্যান্স কমেছে সিঙ্গাপুর ও আরব আমিরাত থেকে।
বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার বৈধ মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক। বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস পরিচালনা করে দেশীয় ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশে নিয়ে আসে। রেমিট্যান্স দেশে নিয়ে আসতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোই এখন বেশি অবদান রাখছে। মোট রেমিট্যান্সের ৭৫ দশমিক ৭১ শতাংশই এসেছে বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর ’২১ প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ৪০৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার এসেছে।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) মাধ্যমে। সর্বশেষ প্রান্তিকেও ব্যাংকটির মাধ্যমে মোট রেমিট্যান্সের ২৮ দশমিক ১২ শতাংশ এসেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে এসেছে মোট রেমিট্যান্সের ২১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে। সর্বশেষ প্রান্তিকে ব্যাংকটির মাধ্যমে ৫০ কোটি ৬১ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এেেসছে, যা মোট রেমিট্যান্সের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে সরকারের আমদানি ব্যয়ের দায় মেটাতে বড় ভূমিকা রাখে অগ্রণী ব্যাংক। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করতে আমাদের পরিচালনা বোর্ড বিশেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রণোদনার অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর সুবিধা এখন পাচ্ছে অগ্রণী ব্যাংক। ফলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রবাসীদের যাওয়ার সংখ্যাও বাড়বে। তখন রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে।’
রেমিট্যান্স আহরণে এর পরই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমেও আসছে প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেমিট্যান্সের দ্বিতীয় জোগানদাতা দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি থেকে গত প্রান্তিকে মোট রেমিট্যান্সের ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ এসেছে। এর পরই তালিকায় থাকা দেশের মধ্যে ইউনাইটেড আরব আমিরাত থেকে আট দশমিক ২৫ শতাংশ, মালয়েশিয়া থেকে পাঁচ দশমিক ৩৮ শতাংশ, কুয়েত থেকে আট দশমিক ১৭ শতাংশ, যুক্তরাজ্য থেকে আট দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ওমান থেকে পাঁচ দশমিক ৩৯ শতাংশ এসেছে।
জানা গেছে, এখনও মোট রেমিট্যান্সের ৫৫ শতাংশ আসছে গল্ফ দেশগুলো থেকে। এছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে আট দশমিক ২৯ শতাংশ রেমিট্যান্স এসেছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সরকার এখনও দুই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এর ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোয় আগ্রহী হয়ে উঠছে। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে (২০২০) বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে গেছেন দুই লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ ব্যক্তি। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন এক লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জন, যা মোট প্রবাসে যাওয়া ব্যক্তির মধ্যে ৭৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বন্ধ থাকা বাংলাদেশের শ্রমবাজার আবার চালু করতে হবে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বিষয়টি সমাধানে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক উদ্যোগ। মুসলিম বিশ্বের এ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবসময়ই সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। সেই উষ্ণ সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তাহলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্প্রসারিত হবে দেশের শ্রমবাজার, যা দেশের বেকারত্ব কমাতে সহায়তা করবে।