ড. মতিউর রহমান: প্রতি বছর পহেলা অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়। দিবসটির উদ্যাপন সমাজে প্রবীণ ব্যক্তিদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার ও প্রশংসা করার সুযোগ দেয় এবং তাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরে।
এ বছর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো‘বয়স্ক মানুষের জন্য মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা: প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে (Fulfilling the Promises of the Universal Declaration of Human Rights for Older Persons: Across ‡enerations)| এই থিমটি বয়স্ক মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সংগত বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আন্তঃপ্রজš§ সংহতি গড়ে তোলার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।
বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা অভূতপূর্ব হারে বার্ধক্য পাচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে ২.১ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হবে। এই জনসংখ্যাগত পরিবর্তন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই নিয়ে আসে।
অপরদিকে বিশ্বব্যাপী ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের সংখ্যা ২০২১ সালের ৭৬১ মিলিয়ন থেকে থেকে ২০৫০ সালে ১.৬ বিলিয়ন হবে। ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়ছে। জনসংখ্যা বার্ধক্য একটি অপরিবর্তনীয় বৈশ্বিক প্রবণতা। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ১০ জনের মধ্যে একজনের বয়স ছিল ৬৫ বা তার বেশি। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী এই সংখ্যা ছয়জনের মধ্যে একজন হবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের প্রবীণ নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ (দুই কোটি ৫০ লাখেরও বেশি)। দেশে বর্তমানে ৬৫ বা তার বেশি বয়সী ১ দশমিক ৫৩ কোটি মানুষ রয়েছে, যারা মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। যদিও দীর্ঘ আয়ু স্বাস্থ্যসেবা ও জীবনযাত্রার অবস্থার অগ্রগতির একটি প্রমাণ, এটি বয়স্ক ব্যক্তিদের মানিয়ে নেয়া এবং তা সুনিশ্চিত করার জন্য সমাজ ও সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস এই সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বর্ণিত নীতিগুলোকে আবার নিশ্চিত করে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা, মানবাধিকারের প্রতি বিশ্বের অঙ্গীকারের ভিত্তি হিসেবে রয়ে গেছে। এর সমতা, মর্যাদা ও স্বাধীনতার নীতিগুলো বয়স্ক ব্যক্তিসহ সব বয়সের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এই বছরের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে বিশ্বের সব প্রবীণ মানুষের জন্য আমরা কীভাবে এই নীতিগুলোকে আরও ভালোভাবে বজায় রাখতে পারি, তার প্রতিফলন করা অপরিহার্য।
সক্রিয় বার্ধক্য বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রতিশ্রুতি পূরণের একটি মৌলিক দিক। সক্রিয় বার্ধক্য কেবল দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার জন্য নয়, এটি একটি পরিপূর্ণ জীবনযাপন, একজনের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং সমাজে অবদান রাখার বিষয় হিসাবে গণ্য হয়।
সরকার ও সম্প্রদায়গুলোকে অবশ্যই এমন নীতি এবং প্রোগ্রামগুলোয় বিনিয়োগ করতে হবে, যা বয়স্ক ব্যক্তিদের সক্রিয় এবং নিযুক্ত থাকতে সহায়তা করে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার, আজীবন শেখার সুযোগ এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি। বয়স্ক ব্যক্তিদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি এবং মূল্যায়ন করে, সমাজগুলো সমস্ত প্রজšে§র সুবিধার জন্য তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে।
বয়সের ওপর ভিত্তি করে বার্ধক্যগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য একটি বিস্তৃত সমস্যা হিসাবে রয়ে গেছে। এটি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার নীতিগুলোকে দুর্বল করে, বিশেষ করে সমতা এবং বৈষম্যহীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোয়। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে বার্ধক্যজনিত বৈষম্যের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো স্বীকার করা এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের দিকে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বার্ধক্যজনিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন, যাতে শিক্ষা, মিডিয়া ও আইন জড়িত থাকে। বাঁধাধরা নিয়ম ও কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করে আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যা বয়স নির্বিশেষে তার সব সদস্যের অবদানকে মূল্য দেয়।
প্রবীণদের প্রতি শারীরিক, মানসিক, আর্থিক নির্যাতন বা অবহেলা একটি গভীরভাবে সম্পর্কিত বিষয়, যা বয়স্ক ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা লঙ্ঘন করে। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসটি প্রবীণদের প্রতি নির্যাতনের ব্যাপকতা এবং এটি প্রতিরোধ ও সমাধানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি সুযোগ হিসেবে কাজ করে।
বয়স্ক ব্যক্তিদের অপব্যবহার ও শোষণ থেকে রক্ষা করার জন্য সরকার, সম্প্রদায় এবং ব্যক্তিদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বয়স্কদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সহায়তা পরিষেবা প্রদান করা এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যতœশীল মনোভাব প্রচার করা।
এই বছরের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের থিম, প্রজন্মজুড়ে আন্তঃপ্রজন্ম সংহতির গুরুত্বকে বোঝায়। প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধ সামগ্রিকভাবে সমাজকে উপকৃত করে। বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে শেয়ার করার জন্য প্রচুর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে, যখন তরুণ প্রজন্ম নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্ভাবন নিয়ে আলোচনা করে।
মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপ এবং শিক্ষাগত সহযোগিতার মতো উদ্যোগের মাধ্যমে আন্তঃপ্রজন্মের সংযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা করা উচিত। এই মিথস্ক্রিয়াগুলো কেবল বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লড়াই করে না, বরং প্রজন্মের মধ্যে বোঝাপড়া ও সহানুভূতিও বৃদ্ধি করে।
মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি সব বয়সের মানুষের জন্য মৌলিক মানবাধিকার। ব্যক্তির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়তে পারে। এটি নিশ্চিত করা অপরিহার্য যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাগুলো এই চাহিদাগুলো পূরণ করতে প্রস্তুত। রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং বার্ধক্য যতœসহ পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলো বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য প্রাপ্তিযোগ্য ও সাশ্রয়ী হওয়া উচিত।
স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি যত্নের বিকল্পগুলো, যেমন নার্সিং হোম ও বাড়িভিত্তিক যত্ন, যাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সহায়তা প্রয়োজন তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রচার, দীর্ঘমেয়াদি যত্ন পরিষেবাগুলো প্রসারিত ও উন্নত করতে সরকার এবং সম্প্রদায়গুলোর কাজ করা উচিত।
ডিজিটাল যুগ বয়স্ক ব্যক্তিদের সংযুক্ত থাকার, তথ্যপ্রাপ্তিতে এবং সমাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভূতপূর্ব সুযোগ দেয়। প্রযুক্তি সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কমাতে এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাধীন জীবনযাপন করতে সক্ষম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে সরকার, প্রযুক্তি কোম্পানি ও সুশীল সমাজের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। প্রশিক্ষণ, সাশ্রয়ী মূল্যের ডিভাইস এবং অ্যাক্সেসযোগ্য অনলাইন পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে ডিজিটাল যুগে বয়স্ক ব্যক্তিরা পিছিয়ে থাকবেন না।
বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য বয়সবান্ধব সম্প্রদায় তৈরি করা অপরিহার্য। বয়সবান্ধব সম্প্রদায়গুলো বয়স্ক বাসিন্দাদের চাহিদা এবং পছন্দগুলোকে পূরণ করার জন্য সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর বার্ধক্য প্রচার করে।
এই ধরনের সম্প্রদায়গুলোয় প্রবীণদের জন্য প্রবেশযোগ্য অবকাঠামো, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এবং আবাসনের ব্যবস্থা থাকে, যা বয়স্ক ব্যক্তিদের পরিবর্তিত চাহিদাগুলো পূরণ করে। স্থানীয় সরকার এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের উচিত বয়সবান্ধব নীতি, নকশা এবং অবকাঠামো তৈরিতে অগ্রাধিকার দেয়া, যাতে সব বয়সীদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখার জন্য আবার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। জনসংখ্যার পরিবর্তিত কাঠামো প্রবীণ ব্যক্তিদের সম্মুখীন হওয়া অনন্য চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করার আবশ্যকতার ওপর জোর দেয়, যা বার্ধক্যবাদ এবং বয়স্কদের প্রতি নির্যাতন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি পর্যন্ত বিস্তৃত।
প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা কেবল ন্যায়বিচারের বিষয় নয়, এটি বিশ্বব্যাপী সমাজের মঙ্গল ও সমৃদ্ধির জন্য একটি বিনিয়োগ। প্রজš§জুড়ে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমরা এমন একটি বিশ্ব তৈরি করতে পারি, যেখানে প্রবীণ ব্যক্তিদের সম্মান করা হয়, মূল্য দেয়া হয় এবং পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়। সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য প্রবীণদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অবদান রাখে।
ড. মতিউর রহমান
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী