জাহিরুল ইসলাম: চলতি বছরের জুন সমাপনীকেন্দ্রিক দেশের ব্যাংক খাতের বিভিন্ন তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ মাসটিতে ব্যাংকগুলো সম্পন্ন করেছে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক। বলা ভালো, ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা ঋণের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে প্রভিশন (সঞ্চিতি) জমা রাখে, হিসাব থেকে তা রাখা হয় প্রত্যেক প্রান্তিক শেষে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে প্রভিশন দরকার ছিল ৪৩ হাজার ৬৪০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা; এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৪৯ কোটি আট লাখ টাকা। অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে দেশের ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, এ তালিকায় কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক থাকলেও এগিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্তগুলো। এর মধ্যে একটি ব্যাংকেরই ঘাটতি রয়েছে ব্যাংক খাতের প্রয়োজনীয় মোট প্রভিশনের প্রায় অর্ধেক।
অনেকের জানা, কোনো ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ করে মুনাফা কিংবা উদ্যোক্তাদের জোগানো পুঁজি থেকে। এটা করা হয় গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এটা সংরক্ষণ করা হয় বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে; সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের সঞ্চয়ের বিপরীতে নয়। ব্যাংক যখন বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারে না, তখন গ্রাহকের আমানত ফেরত দেওয়ার জন্য তাকে সম্পদ আনতে হয় প্রভিশন থেকে। প্রয়োজন অনুযায়ী এটা না থাকলে গ্রাহকের আমানত ফেরত দেওয়া সম্ভব হয় না। সেজন্য বলা হয়Ñযে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি যত বেশি, সে ব্যাংকে গ্রাহকের আমানত ততটাই অনিরাপদ।
আগেই উল্লেখ করেছি, দেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে, তার সিংহভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের। এর মধ্যে একটি দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এ ব্যাংকের প্রতি এখনও ‘আস্থা’ রয়েছে অনেকের। তারা ব্যাংকটিতে আমানত রাখেন আশপাশে অন্য ব্যাংকের শাখা নেইÑশুধু এজন্য নয়, কম দামে সেবা পাওয়ার জন্য। এভাবেই শাখা, গ্রাহকসংখ্যা ও আমানতের পরিমাণ সব দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক হয়ে উঠেছে সেটি। এ তালিকায় আরও যে দুটি ব্যাংক রয়েছে, সেগুলোও কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেখেছে একই ধরনের ভূমিকা। বলা বাহুল্য, খেলাপি ঋণ বেশি হলেও এসব প্রতিষ্ঠান মুনাফা করে অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। কারও কারও বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ না করে পরিচালন মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর। এ অবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে এমন প্রতিষ্ঠানের যদি প্রভিশন ঘাটতি থাকে, তাহলে যেসব মানুষ অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে সেখানে আমানত রাখছে, সেগুলোর নিরাপত্তা দেবে কে?
অনেকে হয়তো বলবেন, ব্যাংকের মালিকপক্ষ যেহেতু রাষ্ট্র, সেহেতু ঘাটতির টাকা জোগাবে সরকার। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠবেÑসরকার টাকা জোগাবে কোত্থেকে? অবশ্যই রাজস্ব আয় থেকে। চলতি ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটেও একই কারণে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। তখন এটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল অনেক। কেউ কেউ এ প্রশ্নও তুলেছিলেন, খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে জোর না দিয়ে জনসাধারণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে মূলধন জুগিয়ে পরোক্ষভাবে খেলাপি হওয়ার প্রবণতাকে কি উৎসাহ জোগানো হচ্ছে না? বস্তুত রাষ্ট্র এ ধরনের সহায়তা অব্যাহতভাবে জোগাতে থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কিছুটা হলেও ঝিমিয়ে পড়েন। তাদের কারও কারও মধ্যে এ মনোভাব স্বভাবতই কাজ করে, সরকার তো টাকা দিচ্ছেই; তাহলে খেলাপি ঋণ আদায়ে অযথা দৌড়-ঝাঁপের দরকার কী?
রাষ্ট্র তার মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানকে জনসাধারণের করের টাকায় কতকাল মূলধন জোগাবে, সেটাও বড় প্রশ্ন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বর্তমানে প্রভিশন ঘাটতি প্রায় সাত হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠবেÑএ টাকাও কি তাহলে রাষ্ট্র জোগাবে? ধারণা করি, এবারের বাজেটে বরাদ্দ রাখার পর যেমন সমালোচনা হয়েছে, তাতে আগামীতে এ ধরনের বরাদ্দ রাখার আগে বহুবার ভাববেন অর্থমন্ত্রী। যদি বরাদ্দ রাখা না হয়, তাহলে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? এও মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র যদি জনসাধারণের করের টাকায় কোনো প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের ভর্তুকি জোগায়, তাহলে করদাতারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এটাকে তাদের ওপর পদ্ধতিগতভাবে চাপানো ‘অবিচার’ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, মূলধন ঘাটতিতে যে কয়টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছেÑপরিচালন মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতায় এদের অন্তত একটি থাকে তালিকার উপরের দিকে। বস্তুত মোট পরিচালন মুনাফা থেকে সঞ্চিতি রাখার পাশাপাশি করপোরেট কর পরিশোধের পর যা থাকে, সেটাই প্রকৃত মুনাফা। এর ওপরই ভিত্তি করে শেয়ারহোল্ডারদের দেওয়া হয় লভ্যাংশ। প্রচলিত আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকলে সে প্রতিষ্ঠান তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত যেসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে, তারা লভ্যাংশ দিচ্ছে কীভাবে? বিষয়টি কি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অজানা?
প্রতি বছর কিছু ব্যাংককে দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় প্রভিশন কম রাখতে। এতে বেড়ে ওঠে তাদের প্রকৃত মুনাফা। তাতে আর কারও না হোক, অন্তত ভাগ্য খোলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও শেয়ারহোল্ডারদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে নয়, বেসরকারিগুলোকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিচ্ছে এমন সুবিধা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের না হয় এক ধরনের ভরসা আছে; কিন্তু প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা বেসরকারি ব্যাংককে অর্থ জোগাবে কে? বাস্তবতা হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহক আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্বে নিযুক্ত। আগে তার কাদের স্বার্থ দেখা উচিতÑকোনো ব্যাংকের কর্মী কিংবা শেয়ারহোল্ডারের, নাকি আমানতকারীর। একই প্রতিষ্ঠানকে বারবার অনুমতি কিংবা বিশেষ বিবেচনায় সুবিধা দেওয়া হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে সাধারণের মনে সৃষ্টি হয় সন্দেহ।
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় জবাবদিহিতা এমনিতেই কম। এজন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি। গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সাম্প্রতিককালে সরকারের নীতিগত কারণে আমানতের মুনাফার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মুনাফায় এবং বিনা জামানতে ঋণ বিতরণ করতে হচ্ছে এসব ব্যাংককে। মনে রাখতে হবে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ ধরনের কার্যক্রম নেওয়া হলেও তাতে উৎসাহী হন ঋণখেলাপিরা। অনেক খেলাপিকে দেখা যায় এ ধরনের কম মুনাফা ও বিনা জামানতে ঋণ নিয়ে আগেরটি পরিশোধ করতে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে যে মুনাফা পাওয়া যায়, তা এসব ঋণের মুনাফার চেয়ে বেশি। এ ধরনের ঋণ নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের মতো উদাহরণও রয়েছে। এজন্য বিশেষ ঋণ কাকে দেওয়া হচ্ছে, তিনি এটি পাওয়ার উপযুক্ত এবং প্রকৃত সুবিধাভোগী কি না, তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। দুটি কারণে এটা খুব দরকার। এক. এ ধরনের ঋণকে সরকার দেখাচ্ছে ‘উন্নয়ন’ হিসেবে। প্রকৃত ব্যক্তিদের ঋণ দেওয়া না গেলে পরিসংখ্যানগত দিক থেকে উন্নতি হলেও প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন হবে না। দুই. জামানতবিহীন ঋণে প্রভিশন রাখতে হয়। যথাসময়ে তা আদায় করা না গেলে ওইসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি আরও বাড়বে। যেসব ব্যাংক এরই মধ্যে প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে, তাদের এমন দায়িত্ব দেওয়া হলে ওইসব ব্যাংকের সঞ্চয়ী গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা হবে আরও বেশি হুমকির সম্মুখীন।
নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, ব্যাংক কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। এখানে গ্রাহকরা আমানত রাখেন নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য। চাহিবামাত্র তাকে তা ফেরত দিতে ব্যাংক বাধ্য। তাই প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে সর্বতোভাবে গ্রাহকস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া ও তার আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এজন্য ঋণও দিতে হবে দেখেশুনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও উচিত হবে নির্দেশনা জারির সময় আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মনে রাখতে হবে, কোনো গ্রাহকের যদি স্বার্থহানি ঘটে তাহলে শেষ পর্যন্ত সে কিন্তু তারই দ্বারস্থ হবে। তার জারি করা কোনো নির্দেশনার কারণে এ ধরনের পরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠলে এর দায় প্রতিষ্ঠানটি এড়াতে পারে না। তাই কোনো ব্যাংককে প্রয়োজনের তুলনায় কম সঞ্চিতি রাখার ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার আগে এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। ব্যাংক খাতে অলস টাকা আছে, থাকুক। কিন্তু সেটা যার-তার হাতে তুলে দেওয়ার আগে ভাবতে হবে সেই গ্রাহকের কথাÑযিনি ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন কষ্টের উপার্জনে। সম্ভবত এটাই কারও কারও শেষ সম্বল।
ব্যাংক কর্মকর্তা
zahirul.duÑgmail.com