Print Date & Time : 5 August 2025 Tuesday 1:07 am

প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ায় সুফল ভোগ করছে জাতি

মিজানুর রহমান পলাশ: রেবেকা এসএসসি পাস করার পর আর এগুতে পারেনি। অকালে বাবার মৃত্যু আর পরিবারে চরম আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় রেবেকা। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। বর্গাচাষি বাবার সামান্য উপার্জনে পাঁচজনের সংসার কোনোমতে চলে যাচ্ছিল। একদিন ক্ষেতে কাজ করার সময় হঠাৎ বজ পাতে মারা যান রেবেকার বাবা। সংসারের অভাব মেটাতে তিন সন্তান নিয়ে আছিয়া খাতুন চলে আসেন ঢাকায়। খিলগাঁও বস্তিতে ঘরভাড়া নিয়ে অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন আছিয়া। আর রেবেকা গার্মেন্টে কাজ নেয়। গার্মেন্টের সুপারভাইজারের খারাপ নজরে পড়ে রেবেকা। একপর্যায়ে সে চাকরি ছেড়ে দেয়।

এসএসসি পাস করা রেবেকার একটি চাকরি খুবই প্রয়োজন। এ সময় সরকারি যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণের বিজ্ঞাপন নজরে আসে তার। খুব সামান্য প্রশিক্ষণ ফি দিয়ে ছয় মাসের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স করে রেবেকা। এখন সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। ছোট দুই ভাইও লেখাপড়া শিখছে। দারিদ্র্য জয় করতে পেরেছে রেবেকা।

বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে এবং সেইসঙ্গে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশে ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। একটি দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ও মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুততর হয়। এভাবেই একটি দেশ এগিয়ে যায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে।

নারীর ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষা অতীব জরুরি। যে সমাজ নারীকে অবহেলা করে এবং তাদের শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে অশিক্ষিত রাখে, তারা কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত শিক্ষা নারীদের আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে সাহয্য করে। তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত নারীকে চাকরি বা জীবিকানির্বাহে বেগ পেতে হয় না। সরকার এ লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তিকে মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছে।

গ্রামাঞ্চলেও প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে যাচ্ছে নারী। দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ৭১ দশমিক চার শতাংশ নারীর হাতে এখন মোবাইল ফোন আছে। এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, তিন মাসে কমপক্ষে একবার মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন দেশের ৯৮ শতাংশ নারী। মোবাইল শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, প্রাত্যহিক জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্ত সব পরিবারেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়ছে। জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ পরিবারে একটি ল্যান্ড ফোন বা মোবাইল ফোন আছে। ২০১২-১৩ সালে এই হার ছিল ৮৭ শতাংশ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যোগাযোগের এ মাধ্যম আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

‘প্রগতির পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে সম্প্রতি বিবিএস একটি সমীক্ষার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য বৃহৎ পরিসরে ইউনিসেফের সহায়তায় বিবিএস এবারের জরিপটি করেছে। নারী ও শিশুসংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক সর্বশেষ তথ্য এই জরিপের মাধ্যমে উঠে এসেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ৬১ দশমিক পাঁচ শতাংশ থাকলেও এই হার এখন ৯২ দশমিক দুই শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে শিক্ষার হার ৮২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮৮ দশমিক সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশে অর্ধেক পরিবার টেলিভিশন ব্যবহার করছে। ছয় বছর আগেও ৩৮ শতাংশ পরিবারে টেলিভিশন ছিল। তাছাড়া বিনোদনের মাধ্যমও পরিবর্তন হচ্ছে। ইউটিউব, ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।

সরকার গ্রামীণ নারীকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনার জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি উপজেলা ও ইউনিয়নে তথ্যসেবা কেন্দ্র বর্তমান সরকারের সময়েই বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রায় এক কোটি গ্রামীণ নারীকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা, ই-কমার্স সেবা গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া, ই-লারনিং বা ই-শিক্ষার মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ নারীদের দল তৈরি করা এবং ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা বা অনলাইন সেবাকে এই কর্মসূচির মাধ্যমে আরও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য।

আইসিটি খাতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের আয় ছিল দুই কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে তথ্য ও প্রযুক্তি খাত থেকে প্রতি বছর রাজস্ব আয় বাড়ছে। এই শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা বিশাল, কিন্তু তথ্য ও প্রযুক্তিজ্ঞান-সমৃদ্ধ মানবসম্পদ গড়ে তোলা একটি চ্যালেঞ্জ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তথ্য ও প্রযুক্তি শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। বাংলাদেশ বিগত

১০ বছর ধরে তাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে; ২০২১ সালের মধ্যে নি¤œ মধ্যবিত্ত দেশের

কাতারে পদার্পণ করব।

ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি তরুণ প্রজš§কে আইসিটি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আজকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন যেমন করা যায়, তেমনি পরীক্ষার ফলাফলও জানা যায়। একইভাবে বিদেশে চাকরির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের অফিশিয়াল বা সরকারি ফরম সংগ্রহ, ট্যাক্স বা আয়কর রিটার্ন দাখিল, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ প্রভৃতি কাজকর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যায়। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশে ডিজিটাল নবজাগরণের অল্প কয়েকটি নমুনা।

মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন এবং অনলাইন ব্যাংকিং এখন হাতের মুঠোয়। মায়েরা সন্তানের উপবৃত্তির টাকা ঘরে বসে মোবাইলের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেশে টেলি-মেডিসিন সেবার দ্রুত বিকাশ ঘটছে। হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আন্তর্জাতিক মানের সেবা স্কাইপের মাধ্যমে নোয়াখালী বা চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীরা পাচ্ছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যেমন রোগের চিকিৎসা চলছে, তেমনি গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলের প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরাও ঢাকায় বসে অনেক সময় প্রকল্প উদ্বোধন করেন, জনসভায়ও তাদের বক্তব্য সরাসরি দেখানো হয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অভিযাত্রায় সারা দেশে পাঁচ হাজার ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার বা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব তথ্যকেন্দ্র ও সেল স্থাপনের সুফল ভোগ করছে পুরো জাতি। পোস্ট অফিসও এখন তথ্যপ্রযুক্তি সেবার আওতায় চলে এসেছে। সরকার দেশব্যাপী ৯ হাজার গ্রামীণ পোস্ট অফিস এবং প্রায় ৫০০ উপজেলা পোস্ট অফিসকে ই-সেন্টারে পরিণত করেছে। ডাকঘরের মাধ্যমে মোবাইল মনি অর্ডার ও পোস্টাল ক্যাশ কার্ডসেবা চালু একটি মাইলফলক। এসব পরিষেবার মতো আগামী দিনগুলোয় আরও অনেক নিত্যনতুন সেবা চালু হবে।

জেলা সদরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে গ্রামের মানুষকে এখন নানা ধরনের ই-সেবা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে সরকার নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পরিষেবা চালু করার ফলে এখন মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমেছে। মানুষের সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প গ্রহণের পর এই খাত নিয়ে কাজ করা শুরু করেন তার ছেলে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তার হাত ধরে পাওয়া এই সাফল্যের কারণেই চারটি খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে ‘আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার প্রদান করে জয়কে। প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকÑএটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পিআইডি নিবন্ধ