জয়নাল আবেদিন: ডিজিটাল ছোঁয়া দুনিয়ার এক বিস্ময়। যার নিয়ামক সফটওয়্যার, স্বয়ংক্রিয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। এটি পাল্টে দিয়েছে মানুষের গতানুগতিক ধারণা। সহজ করেছে দৈনন্দিন জীবনযাপন। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে এনেছে চোখে পড়ার মতো কাল্পনিক ধারার নিরেট বাস্তবমুখী অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ফলে এখন দেশ-বিদেশের সব ব্যাংকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজলেও চোখে পড়ে না সেই বাব-দাদা থেকে চৌদ্দ গোষ্ঠীর আমলের জমানো কাগজের স্তূপ। নেই টাকা জমা কিংবা উত্তোলনে অজগড়ের মতো পেঁচানো সারি। এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ও ভিসা কার্ডসহ ঘরে বসে মোবাইলে লেনদেন ব্যাংকিংকে নিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়।
নতুন সংযোজন হিসেবে রয়েছে বিকল্প কার্ডবিহীন লেনদেনের অবারিত সুযোগ। এসব সুবিধার ফলে ব্যাংকিং সেবা গ্রাহকের ঘরে পৌঁছে গেছে। সুতরাং এখন বলাই যায়, ব্যাংকের গ্রাহক নয়, সেবাই গ্রাহকমুখী। এমনকি সত্যিই গ্রাহকের হাতের ডগায় ব্যাংকিং সেবা চলে যাওয়ায় বর্তমানে ব্যাংকের আঙিনায় আনাগোনা কমেছে।
আর নতুন চমক হিসেবে আগামীর বাংলাদেশেও ডিজিটাল মুদ্রা ও ডিজিটাল ব্যাংক এবং ঋণের জামানত হিসেবে অস্থাবর সম্পত্তির ব্যবহার ব্যাংকিংয়ে সরলীকরণের নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। এছাড়া ক্যাশলেস (নগদ বিহীন) সোসাইটি গড়ার চলমান উদ্যোগ তো রয়েছেই। মূল কথা ডিজিটাল ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় ব্যাংক নয়, ব্যাংকিংই হবে আরও বেশি গ্রাহকমুখী। আর সে পথেই এগিয়ে চলছে বর্তমান ডিজিটাল সভ্যতার গ্লোবাল নাগরিকরা। এখন অপেক্ষার পালা শুধু শতভাগ বাস্তবায়নের ও গ্রাহকের তৃপ্তির ঢোক গিলবার দৃশ্য দেখার। এমন ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার যথার্থ অনুধাবন করে ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে বিশ্ব খ্যাত ধনকুবের ও মাইক্রাসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছিলেন, ‘আমাদের ব্যাংকিং দরকার, আমাদের কি আসলেই ব্যাংক দরকার?’
ব্যাংক খাতের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সেবা যেন ইতোমধ্যে মানুষের মধ্যে ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকা তিক্ত অভিজ্ঞার স্মৃতি গ্রাহকের মন থেকে মুছে ফেলেছে। সেই সঙ্গে গ্রাহকের মগজ থেকে জাল টাকার ভীতি দূর হয়েছে। গ্রাহকের মধ্যে নেই লেনদেন সময়ে সূচি মানার সেই দৌড়ঝাঁপ। টাকা গণনা, সুতা বারবার দিয়ে লাল কলমের সঙ্গে অন্য কালির কলম যুক্ত করে বেঁধে রাখার বদলে ব্যাংকের লেটেস্ট ভার্সনের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে এখন। নতুন ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি এক কিলিক বা এক বাটনে চাপ দিয়েই সেবার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। আর অ্যাপসের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সেবা তো রয়েছেই। এখন গ্রাহকের হিসাব, লেনদেন ও সেবার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রয়েছে দুই থেকে পাঁচ স্তরের ডিজিটাল নিরাপত্তা বলয়, মোবাইলে বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে গ্রাহক শনাক্তকরণ ও ওটিপি (অনটাইম পাসওয়ার্ড) কোর্ড পদ্ধতি। এতে ব্যাংক গ্রাহকের ভয় কেটে তা আস্থা সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বর্তমানে ব্যাংক বলতে সেই আমলের আমানত কিংবা জামানতগ্রহণকারী কোনো প্রতিষ্ঠানকে বুঝায় না। এটি এখন কেবল ঋণ প্রদান বা ঋণ আদায়কারী সংস্থাই নয়। ইতোমধ্যে অধিকাংশ ব্যাংক তাদের কার্যক্রম নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী বহুমুখী সার্বক্ষণিক সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বিশ্বের সব ব্যাংকের মতো আমাদের দেশেও ব্যাংকসমূহ গ্রাহকের ব্যবসা-বাণিজ্য, দেনা-পাওনা ও কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিল পরিশোধ, কর প্রদান, কোর্ট ফি, ভর্তি ফি, পরীক্ষা টিউশন ফি ও জরিমানা প্রদানসহ যাবতীয় সেবা প্রদান করছে। আর চিকিৎসার ফি, টাকা ট্রান্সফার ও মোবাইল রিচার্জসহ কার্যক্রমও ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। এছাড়া প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স সংগ্রহেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের গ্রাহকসংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক সাড়ে ৫ কোটি। আর দেশজুড়ে এজেন্ট রয়েছে ১০ লাখ ৪৪ হাজার। বিকাশের গ্রাহক ৫ কোটি, রকেটের গ্রাহক ৩ কোটি, নগদের গ্রাহক প্রায় ৪ কোটি। গড়ে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
দেশের স্বাধীনতার পর ডিজিটাল ব্যাংকিং ছিল অনেকটা কল্পনার মতো। যদিও এখন এটি অতি ব্যবহারিক ও মামুলি বিষয় মনে করেন তরুণ প্রজšে§র সদস্যরা। যদিও এর সূচনাটা নব্বইয়ের দশকে দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার মাধ্যমে শুরু হয়। সেই থেকে অনেকে মোবাইল ফোনের ব্যবহারের মতো ব্যাংকিং সেবা চালুর ভাবনা শুরু করে। এভাবে চলে যায় প্রায় দেড় যুগ। ২০১০ সালে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রদান নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়। আর দেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ এমএফএস সেবা চালু করে। পরবর্তী সময়ে নগদ, এমক্যাশ, উপায়, শিওরক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা চালু করে। সারাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য নিবন্ধন করেছে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ। আর প্রায় সাড়ে ৫ কোটি হিসাব চালু রয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হয় না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেয়া হচ্ছে।
ব্যাংক খাতে ডিজিটাল সেবা শুরু করেছে প্রায় এক যুগ আগে। এর মধ্য দিয়ে আগের থেকে সস্তায় ও সহজে সবাইকে ব্যাংকিং সেবা দেয়ার পথ সৃষ্টি হয়েছে। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কোনো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে লেনদেনের সুযোগ করে দিতে পারছে নিমিষেই। শুরুর দিকে ব্যাংক টু ব্যাংক ডিজিটাল আন্তঃসংযোগ শুরু হলো। এতে একটি ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা তুলতে যে সাত দিন লাগত, এখন সকালে জমা দিলে বিকালে পাওয়া যায়। এরপর ইএফটি (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) এলো। সেখানে ঘরে বসে মোবাইল বা অ্যাপের মাধ্যমে এক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা যাচ্ছে। এটিএম কার্ড আসার শুরুর দিকে যে ব্যাংকের কার্ড, সেই ব্যাংকের বুথেই ব্যবহার করা যেত। এখন সেখানেও আন্তঃসংযোগ হয়েছে। কেনাকাটার সময়ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখন আন্তঃসংযোগ আছে।
এদিকে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবায় আমরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বড় একটা উদাহরণ সৃষ্টি করছি। এটা আমাদের দেশে প্রায় ১০ বছর হতে চলছে। এই সময়ে মার্কেট তার নিজের মতো সম্প্রসারিত হয়েছে। এই উন্নয়ন হয়েছে কয়েকটি ধাপে। প্রথম পর্যায়ে আমাদেও লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি (পিটুপি) লেনদেনে। পরবর্তী সময়ে সেখানে ব্যক্তি টু ব্যাংক (পিটুবি) ও গভর্নমেন্ট টু পারসন (জিটুপি) পেমেন্টে মানুষকে উৎসাহিত করেছি। এখন অ্যাডভান্স কিছু ফাইন্যান্সিয়াল প্রডাক্ট এসেছে। যেমন সেভিংস, ক্রেডিট বা এই ধরনের আরও কিছু প্রডাক্ট। এখন এই মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বড় একটা কাস্টমার গ্রুপকে অ্যাডভান্স ইউজার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এই দশকটা বিভিন্ন ধাপে মার্কেট গ্রো করেছে।
আমরা এমএফএস টু এফএফএস অর্থাৎ বিকাশ থেকে রকেট, রকেট থেকে বিকাশে লেনদেন করতে পারি না। এটা একটা বড় সমস্যা। ব্যাংক টু এমএফএস বা এফএফএস টু ব্যাংক এবং কার্ড টু ব্যাংক বা ব্যাংক টু এমএফএস, এটা বিভিন্ন পরিসরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতারা সেবা দিচ্ছে। যেটা আমাদের নেই, বিকাশ থেকে রকেট বা রকেট থেকে নগদে লেনদেন, মার্চেন্ট পেমেন্ট অর্থাৎ বিকাশের মার্চেন্টে রকেট দিয়ে পেমেন্ট করাÑএই দুটো আমাদের এখনও নেই। যেহেতু মার্কেট তার নিজের মতো করে গ্রো করেছে। যারা কাস্টমার, তাঁরা তাঁদের চাহিদাটা নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। এই বাধাগুলো আমরা যত কমাতে পারব, মানুষ তত উদ্বুদ্ধ হবেন, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি তত বাড়বে। কভিডকালে এ সেবার ব্যবহার যেভাবে বেড়েছে, আন্তঃসংযোগ পদ্ধতি চালু হলে এর পরিমাণ আরও বহুগুণে বেড়ে যেত। আন্তঃসংযোগকে অবশ্যই আমরা স্বাগত জানাই এবং এটাকে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর করা উচিত।
একসময় দেশের স্বল্পসংখ্যক মানুষ কেবল বেতন তোলা, আমানত জমা কিংবা ঋণ লেনদেনের জন্য ব্যাংকে যেতেন। কেউ কেউ ব্যাংকিং সেবাকে জটিল মনে করতেন। তবে চলতি শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্যাংক ও ব্যাংকিং সেবার প্রসার হতে দেখা গেছে। ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখা মেলে ব্যাংকের শাখা, উপশাখা, আউটলেট এটিএম এবং এজেন্ট ব্যাংকিং বুথ। আর গ্রাহকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বেড়েছে ব্যাংকের সেবার মান। বিশেষ করে ২০০০ সালের পরে অনলাইন, কার্ড এবং মোবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতি চালুর পর ব্যাংকিং খাতে বিপ্লব সৃষ্টি হয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদান করছে ব্যাংকগুলো। ঘরে বসেই ব্যাংকিং সেবা নেয়া যায় এখন। কেনাবেচা, বিল পরিশোধ, পরীক্ষার ফি, চিকিৎসার ফি, টাকা ট্রান্সফার, মোবাইল রিচার্জসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে প্রযুক্তি হলো গ্রাহকদের ব্যাংকিং পরিষেবা সরবরাহের মূল চাবিকাঠি। এখন ব্যাংকগুলো যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময় সেবা গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় গ্রাহক আরও নতুন নতুন চাহিদা তৈরি করছেন। গ্রাহকদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যাংকগুলোকে তাদের সব শাখায় এটিএম, টেলি-ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং প্রভৃতি বিস্তৃত পরিষেবা সরবরাহ করতে হচ্ছে। সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে প্রতিটি গ্রাহককে সন্তুষ্ট করতে হবে। গ্রাহকদের আকর্ষণ ধরে রাখার মূলমন্ত্র প্রযুক্তি। আর গ্রাহকের চাহিদার জন্য অনলাইনের মাধ্যমে আদান-প্রদান বা ই-ব্যাংকিংয়ের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। উন্নত দেশের মতো আমাদের ব্যাংকগুলোও শাখা-সংক্রান্ত বাধা তুলে দিয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে ডিজিটাল রূপান্তরের সঙ্গে গ্রাহকদের অভ্যস্ত করা হচ্ছে। আর ব্যাংকিং খাতকে আরও নিরাপদ, সহজ ও গ্রাহকবান্ধব করতে ডিজিটাল ব্যাংকিং গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে প্রযুক্তির নতুন বন্ধনের সংযোগ সৃষ্টি করেছে। আর এ ডিজিটাল বন্ধনেই হবে আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলার অন্যতম শক্তি।