পাঠকের চিঠি

প্রস্তাবিত বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন কঠিন হবে

জাতীয় বাজেট মূলত প্রত্যেক অর্থবছর সম্পর্কে ওই বছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয় সংবলিত একটি বিবৃতি। বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা হয় ১২ মাসের জন্য যা চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধিতে সংসদে বাজেট পেশ করার ও অনুমোদন গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্থমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ বাজেট ঘোষিত হয় ৯ জুন, ২০২২। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটটি পেশ করেছেন। এবারের বাজেট বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট। এবার বাজেটে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আবাসন খাত, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত, দেশীয় শিল্পের বিকাশকে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির হার ধরা হচ্ছে ৫.৬ শতাংশ।
মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা যার মধ্যে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার (প্রায় ৮৫%) জোগান দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
ঘাটতি পূরণে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে দেশীয় শিল্প সুরক্ষার ওপর মনোনিবেশ করা হয়েছে। বাড়ছে আমদানিকৃত বিলাসজাত বিভিন্ন দ্রব্যের দাম। এর মধ্যে রয়েছেÑবিদেশি বিলাসবহুল গাড়ি, যন্ত্রাংশ এনে তৈরি গাড়ি, বিদেশি ল্যাপটপ, বিদেশি কম্পিউটার, আমদানি করা এসি, ফ্রিজ, চকলেট, জুস, বিদেশি পাখি, আমদানি করা পেপার কাপ এবং প্লেট প্রভৃতি। কতিপয় বিলাসী পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ আমদানি ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে। দাম কমছে কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি যন্ত্রপাতির সরঞ্জাম, দেশীয় উৎপাদিত গাড়ি, স্থানীয় উৎপাদিত মোবাইল ফোন, দেশীয় ল্যাপটপ, দেশীয় রেফ্রিজারেটর, আমদানিকৃত চিনি, সিসিটিভি এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনের। রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর কমানোর কারণে রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বরাবরই বাজেট নিয়ে সমালোচনার শেষ হয় না। একদিকে দেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের দুশ্চিন্তা অপরদিকে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জনসাধারণের মনে আশঙ্কা লেগেই থাকে যেন। সাম্প্রতিক বাজেটগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গতানুগতিক হয়। আয়ের চেয়ে ব্যয়ের খাত বেশি থাকে এবং বৃদ্ধি বেশি দেখানো হয় ও মূল্যস্ফীতি কম। কোনো বছরই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না এবং এর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না।
প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা এবং সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, পরিচালন ব্যয়ে (জিডিপির ৮.৪%) বিপুল বরাদ্দ হ্রাস করা গেলে উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখত। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় দেশের সীমিত মানুষ আরও চাপের মুখে পড়বে। এবারের বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ সাড়ে ৭ শতাংশ সুদে দেশে আনার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ সুযোগকে অনৈতিক, অসাংবিধানিক ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। অর্থনীতিবিদরাও এটিকে অগ্রহণযোগ্য এবং অপকর্মকে স্বীকৃতি দেয়া হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বাজেটে বাড়ানো হয়নি করমুক্ত আয়ের সীমা। সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি না পাওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বস্তি পাবে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় মানুষকে স্বস্তি দিতে এটি জরুরি ছিল। তিনি আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ মাত্র ২ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়েছে, যার কারণে দরিদ্র মানুষ আরও চাপে পড়বে। এদিকে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেছেন, শর্তারোপের কারণে অধিকাংশ কোম্পানি করপোরেট কর হ্রাসের সুফল পাবে না।
দ্রব্যমূল্যের উচ্চ দাম নিয়ে যেখানে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে যা নিছক বোঝা সৃষ্টি করা ছাড়া কিছুই নয়। এবারের বাজেট নিয়ে জনমনে অনেক অসন্তোষ রয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেখানে সরকারি ব্যয় কমানো উচিত ছিল সেখানে সরকারি ব্যয় ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বিরাজমান এই কঠিন সময়ে মেগা প্রকল্পে (কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেল প্রকল্পে ৫১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ) আপাতত বরাদ্দ না বাড়ালেও হতো। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং মুদ্রাস্ফীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই রাজস্ব আহরণে এবং ঘাটতি অর্থায়নে বিশেষ করে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নে সাফল্য দেখাতে না পারলে প্রস্তাবিত বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

রাফিহা বিনতে মিজান
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়