সাঈদ চৌধুরী: বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সম্ভাবনা দিন দিনই বাড়ছে। বাংলাদেশ সবুজ বেষ্টনীর একটি পুণ্যভূমি হওয়ায় এদেশের প্রায় সব জায়গা প্রকৃতিগতভাবেই সবুজ ও শ্যামল। উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম পুরোটা জুড়েই যেন নদী ও জলরাশির অপার খেলা, যা মানুষের মনকে স্নিগ্ধ করে রাখত একটা সময়। বর্তমানে প্রাকৃতিক পর্যটন অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মানুষের তৈরি অনেক পর্যটন কেন্দ্র। দিন যত যাচ্ছে বিদেশিরা আমাদের দেশে আসার আকুলতা ব্যক্ত করছে। পর্যটন অঞ্চলের মধ্যে বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলগুলো। সরকারের অসাধারণ কিছু পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চলে ভ্রমণ হয়ে উঠেছে আরও বেশি আকর্ষণীয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পৌঁছে দেয়া ও পর্যটন খাতের আধুনিকীকরণ, হোটেল-মোটেল তৈরি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রচেষ্টায় পাহাড়ি পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি করার ফলে আকর্ষণীয় ও নিরাপদ হয়ে উঠেছে অনেক দুর্গম জায়গাও।
এত কিছুর পরও পর্যটন খাতকে পিছিয়ে দিতে ভূমিকা রাখছে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি। দেখা যায়, বেশিরভাগ পর্যটন অঞ্চলে বা পর্যটন স্থানে ময়লা আবর্জনা একটি বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যত্রতত্র পড়ে আছে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা, কাগজের ব্যাগ, টিস্যু, মাস্ক ও অন্যান্য সামগ্রী। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে না পারলে স্থানগুলো দিনে দিনে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এছাড়া পর্যটন অঞ্চেলে গড়ে তোলা বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, হসপিটাল ও অন্যান্য স্থাপনার বর্জ্যগুলোও ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যাচ্ছে না। বসতি যেগুলো গড়ে উঠছে, সেগুলোর সুয়ারেজ লাইনও দিয়ে দেয়া হচ্ছে পাশের নদী বা খালে। এভাবেই আস্তে আস্তে হয়ে উঠছে দূষিত জলাভূমি, ফসলের খেত ও আশপাশের পরিবেশ।
এ বছরের প্রথম দিকেই আমরা ঘুরে এলাম রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেকে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল লেকের অসাধারণ সুপেয় পানি দূষণের মুখে। রাঙ্গামাটি জেলা শহরের কোলঘেঁষে পাহাড়ের গা স্পর্শ করে যে কাপ্তাই লেক গড়ে উঠেছে, তার অনেকাংশেই দখলের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তেমনি দূষণও বেড়ে চলছে অত্যধিক হারে।
সরকার দখল-দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে ঠিকই, তবে এ ব্যবস্থাগুলো তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন এই উদ্যোগগুলো পরিকল্পিতভাবে পৌঁছে দেয়া যাবে একেবারে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। পর্যটকদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি কিছু ব্যবস্থাপনাও জরুরি সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিকায়নে সরকার এরই মধ্যে ভালো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে জলাধার সংরক্ষণ ও দূষণমুক্তকরণে হাতিরঝিল প্রকল্পটি উল্লেখযোগ্য। যেখানে আগে দুর্গন্ধে যাওয়াই যেত না, এখন সেখানে স্ক্রিনিং করে কঠিন বা সলিড বর্জ্য তো আলাদা করা হচ্ছেই, পাশাপাশি পানি দূষণমুক্ত করার কাজও চলছে। নদীর দখল ও দূষণ বন্ধে গত বছর জুড়েই বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা পাড়ের সব ফ্যাক্টরির দূষিত পানি নদীতে পড়া বন্ধ করতে ইটিপি বাধ্যতামূলকভাবে চালানোর পাশাপাশি অনলাইন মনিটরিংয়ের আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়কে পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ চলছে।
এরই সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে তুরাগ নদীর পাড়ের কাছাকাছি ১৫ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনা কোম্পানির মাধ্যমে গড়ে তোলা হচ্ছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এই উদ্যোগ সম্পন্ন হলে ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে এবং অনেকাংশেই কমে যাবে দূষণ। পর্যটন অঞ্চলগুলোয় দূষণ কমানোর জন্য সেন্টমার্টিন নিয়ে বারবারই সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়ে বলা হচ্ছে, কীভাবে দূষণমুক্ত রেখে পর্যটন অঞ্চলে ভ্রমণ সুন্দর করা যায়, সে বিষয়গুলো।
২২ ও ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের আয়োজনে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত হলো পঞ্চম জাতীয় নদী সম্মেলন। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। তিনি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সরকারের অনেকগুলো পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। সেন্টমার্টিনসহ কাপÍাই লেকের ভবিষ্যৎ নিয়েও তিনি কথা বলেন। মৎস্য খাতে লগ্নিসহ স্থানীয় জনসাধারণকে এ লেকের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে কাজে লাগানোর বিষয়েও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী মঞ্জুরুল কিবরিয়া গবেষণা প্রবন্ধে কাপ্তাই লেকের বর্তমান অবস্থা ও আগে এই লেকের ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সের অবস্থা কী ধরনের ছিল সে বিষয়ে উল্লেখ করেন। ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের মুখ্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষক ড. মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান খানও সেন্টমার্টিন ও কাপ্তাই লেকের বিভিন্ন ধরনের ইকোলজিক্যাল বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের পর্যটন একটি শিল্প হয়ে ওঠার পেছনে এখনও অনেক কাজ বাকি। কাপ্তাই লেক ভ্রমণের সময় খুব স্বাভাবিকভাবে আমরা দুপুরের খাবারের সঙ্গে সেদিন কাপ্তাই লেকের পানি পান করেছি। গত দুই দশক আগেও গাজীপুরের শ্রীপুরের লবলং সাগরের পানি এভাবেই আমরা খেতে পারতাম। ঠিক বুড়িগঙ্গার পানিও আমরা খেয়েছি ৩০ বছর আগেও। কেবল শুরু হওয়া ভ্রমণের জায়গা এই কাপ্তাই লেক আগামী দুই দশক পর কেমন হবে, তা ভাবনার বিষয় আমাদের অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণে।
আমরা লবলং ঠিক রাখতে পারিনি, তুরাগ ঠিক রাখতে পারিনি, বুড়িগঙ্গাও পারিনিÑবড় বড় নদী ও জলাশয় এখন প্রায় মৃত। এর পেছনে আমাদের অপরিকল্পিত পরিকল্পনার দায়ই বেশি। এই পরিকল্পনাহীনতা স্পষ্টই পরিলক্ষিত হচ্ছে কাপ্তাই লেকের বেলায়ও। দ্রুত প্রয়োজন এই শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট ডাম্পিং এরিয়া নির্ধারণ করা, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা, নৌযানগুলো থেকে তেল দূষণ হওয়ায় জলাশয়, নদী ও খাল মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা। জলাধারের পাশে কৃষিকাজে কীটনাশক ব্যবহার কমানোর জন্য নানামুখী উদ্যোগ নেয়া। বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের আয়োজনে জাতীয় নদী সম্মেলনে দুটি গবেষণাপত্র তুলে ধরা হয়। বক্তারা অনেক গবেষণার কথা বললেও এখনও অনেক বাকি। মাছ উৎপাদন কমেছে অনেক, জলজ প্রাণীর আধিক্যও এখানে তেমন নেই। বিলুপ্ত হয়েছে অনেক মাছও। কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন একেবারেই কমে গেছে এখানে। শুধু কাচকি আর চাপিলা মাছ ছাড়া এ লেকে বড় মাছ পাওয়া প্রায় বিরল।
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক কাপ্তাই লেকের সঙ্গে কয়েকটি উপজেলার পানিপথের যোগাযোগের বিষয়ে গুরুত্ব তুলে ধরেন। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মৎস্যসম্পদ বাড়াতে করণীয় সম্পর্কে আরও গবেষণার জন্য গবেষক ও নদী পরিব্রাজক দলের সবার প্রতি আহ্বান জানান। নদী গবেষক ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনির হোসেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পৌরসভার নিজস্ব উদ্যোগ নেয়ার প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন, প্রতিটি পর্যটকবাহী নৌযানের আলাদা আলাদা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পদক্ষেপ থাকতে হবে। বছরে যে জলাশয়ে ছয় ফিট পর্যন্ত পানি সংরক্ষিত থাকে, সে জলাশয়কে রামসার সাইট কনভেনশনের আওতায় আনা যেতে পারে। কনভেনশনের আওতায় স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে পর্যটন বা অন্যান্য কাজ পরিচালনা করলে দূষণ কমিয়ে জলাধার রক্ষা করা সম্ভব হবে।
কাপ্তাই লেকসহ সব প্রাকৃতিক পর্যটন স্থান এবং প্রাকৃতিক জলাধার বাঁচানো ও সংরক্ষণ করার কোনো বিকল্প নেই। কাপ্তাই লেক ছাড়াও বেশিরভাগ পর্যটন স্থানেই বর্জ্য ব্যবস্থা নাজুক। পতেঙ্গা সি-বিচেও ডাস্টবিনের যথাযথ ব্যবহার নেই। যত্রতত্র ময়লা ফেলার কারণে দ্রুত দূষিত হচ্ছে সাগরের পানি।
সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়গুলো বন্ধে আইন প্রয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, টুরিস্ট পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট সবার একত্রে এ কাজগুলোয় সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন।
সরকারের অনেক লগ্নি, অনেক স্বদিচ্ছা ও পর্যটনের সম্ভাবনা সব ম্রিয়মাণ হয়ে যেতে পারে যদি না সবাই এ বিষয়ে আন্তরিক ভূমিকা পালন করে। এখনই সময় আমাদের পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নেয়ার এবং রক্ষা ও সংরক্ষণের। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে পর্যটনশিল্পের আরও বেশি সম্পৃক্ততা বাড়াতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারসহ আমাদের সবার সুদূরপ্রসারী চিন্তা, উদ্যোগ ও সমন্বিত প্রচেষ্টা পর্যটন স্থানগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে পারে, দিতে পারে প্রাণ, গড়ে তুলতে পারে আকর্ষণীয় ও বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অংশ।
পিআইডি নিবন্ধ