আইপিপি ও রেন্টালে ব্যয় বাড়ছেই

প্রাধান্য দেয়া বেসরকারি খাত এখন বিদ্যুতের বোঝা !

ইসমাইল আলী: চাহিদা মেটাতে একসময় বেসরকারি খাতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয় সরকার। বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যানকে উপেক্ষা করে বিনা দরপত্রে অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। চাহিদা না থাকলেও বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের জন্য গুনতে হয় উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ। দেশীয় ঋণ ও বিনিয়োগে গড়ে তোলা এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেনা হয় সরাসরি ডলারে বা ডলারের বিনিময় হারের ভিত্তিতে। এতে বেসরকারি খাতে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর ব্যয় বাড়ছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ কিনতে হয় বেসরকারি খাতের ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস (আইপিপি) ও ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে। গত অর্থবছর মোট ৯ হাজার ৩৪০ কোটি ২২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে নেয়া হয় চার হাজার ৫৪৩ কোটি ১০ লাখ ইউনিট, যা মোট উৎপাদনের প্রায় সাড়ে ৪৮ শতাংশ। তবে এ বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে পিডিবিকে গুনতে হয়েছে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৫৮ শতাংশ অর্থ।

কয়েক অর্থবছর ধরেই এ চিত্র দেখা যাচ্ছে। আইপিপি ও রেন্টালের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করে পিডিবির লোকসান প্রতি বছর বাড়ছে। গত অর্থবছর আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কিনতে গড়ে ১৩ টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। যদিও ওই সময় বিদ্যুৎ বিক্রির গড় মূল্য ছিল পাইকারিতে সাত টাকারও কম। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের বিদ্যুতে অর্ধেকই লোকসান হচ্ছে পিডিবির। এতে একসময় বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে প্রাধান্য দেয়া হলেও এখন তা দেশের বোঝা বাড়াচ্ছে। পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ কিনতে (নিজস্ব কেন্দ্রসহ) ব্যয় হয়েছে এক লাখ দুই হাজার ৯২৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এরমধ্যে আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ কিনতেই ব্যয় করা হয়েছে ৫৯ হাজার ৭০৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। যদিও গত দুই অর্থবছর বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ওঠানামার কারণে এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ পরিবর্তন হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাপাসিটি চার্জ তো রয়েছেই। তবে বেসরকারি খাতের উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশও ব্যবহার হচ্ছে না। ২০২২-২৩ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল আট হাজার ৭০৩ কোটি ৯৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা (আমদানিসহ)। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির ব্যয় হয়েছিল ৯৮ হাজার ৬৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যদিও সে বছর আইপিপি ও রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছিল চার হাজার ৩৩৪ কোটি ৯৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয়েছিল ৬২ হাজার ৭৬৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৪৯ দশমিক ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় হয় ৬৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ অর্থ।

এর আগের (২০২১-২২) অর্থবছর এ খাতে রেকর্ড ব্যয় হয়েছিল। ওই অর্থবছর মোট আট হাজার ৩৯৩ কোটি ৩৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে নেয়া হয় চার হাজার ৫৪৭ কোটি ৬৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে পিডিবিকে গুনতে হয়েছিল ৫২ হাজার দুই কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা মোট খরচের ৭০ শতাংশের বেশি। ওই অর্থবছর বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির মোট ব্যয় ছিল ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতের ওপর বিদ্যুৎ উৎপাদন যত নির্ভরশীল হবে, ততই ব্যয় বাড়বেÑএটাই স্বাভাবিক। গত অর্থবছর থেকে আবার বাড়ছে আমদানিনির্ভরতা। এতে বেসরকারি খাতে তুলনামূলক কম ব্যয় হলেও আমদানিতে ব্যয় বাড়া শুরু হয়েছে। এতে একদিকে অর্থের অপচয় বাড়ছে, আরেকদিকে বেসরকারি ও আমদানিনির্ভরশীলতা বিদ্যুৎ খাতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। পিডিবির কয়েক বছরের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ কেনা হয়েছিল। এতে ওই খাতে ব্যয়ও হয়েছিল সর্বোচ্চ। এর আগে বেসরকারি খাতের নির্ভরশীলতা কম ছিল। এতে আইপিপি ও রেন্টালে ব্যয়ও তুলনামূলক কম ছিল। তবে সর্বশেষ দুই অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা কমানো হয়। এতে ব্যয়ও আনুপাতিকহারে কমেছে। তবে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালনি তেল ও কয়লার দামের ওঠানামার ফলে এ খাতে মোট ব্যয় কমেনি।

সংস্থাটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির মোট বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৮৫২ কোটি ৫২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে আইপিপি ও রেন্টাল থেকে আসে তিন হাজার ৯০৫ কোটি ৯৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ মোট বিদ্যুতের ৪৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে, যার জন্য ব্যয় করতে হয়েছিল ৩১ হাজার ৬৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সে অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির মোট ব্যয় ছিল ৫১ হাজার ৮৭৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইপিপি ও রেন্টাল খাতে গেছে মোট ব্যয়ের ৫৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পিডিবির মোট বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৯৬৪ কোটি ৭১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে আইপিপি ও রেন্টাল থেকে আসে দুই হাজার ৮৯৬ কোটি ৬৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ মোট বিদ্যুতের ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ এসেছিল বেসরকারি খাত থেকে, যার জন্য ব্যয় করতে হয়েছিল ২০ হাজার ৭৩৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

সে অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির মোট ব্যয় ছিল ৪১ হাজার ৭৩৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইপিপি ও রেন্টাল খাতে গেছে মোট ব্যয়ের ৫০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয়েছিল ৩৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বিদ্যুৎ। তবে এজন্য ব্যয় করা হয়েছিল মোট ব্যয়ের ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ অর্থ। ওই অর্থবছর পিডিবির মোট বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৮৫৯ কোটি ৯৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে আইপিপি ও রেন্টাল থেকে আসে দুই হাজার ৭২০ কোটি ১০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির মোট ব্যয় ছিল ৪১ হাজার ১৯৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে রেন্টাল-কুইক রেন্টালে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৭৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
কয়েক বছরের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় পর্যায়ক্রমে কমে এলেও আইপিপি থেকে বাড়ছে। তবে দুই খাতেই উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য পিডিবিকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।