নজরুল ইসলাম: গ্রাহক থেকে কৌশলে রেখে দিতেন চেকবই। সেই চেকবই দিয়ে গ্রাহকের অজান্তে তুলে নিতেন টাকা। একজন-দুজন গ্রাহক নয়, ৫৯ জন গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন কর্মকর্তারা। এখানেই শেষ নয়। ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবের খাতের টাকা অন্য হিসাবে স্থানান্তর করতেন। আর সেই টাকায় ব্যাংক কর্মকর্তারা তৈরি করতেন এফডিআর। ভুয়া ব্যক্তির নামে তৈরি করা হতো সেই এফডিআর। কিছুদিন পর সেই এফডিআর ভেঙে টাকা তুলে নিতেন কর্মকর্তারা। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে তৈরি করা হতো ভুয়া পে-অর্ডার। সেই পে-অর্ডার দিয়ে কর্মকর্তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতেন। বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখায় এমন জালিয়াতির চিত্র উঠে এসেছে। কর্মকর্তারা যোগসাজশের মাধ্যমে এমন জালিয়াতি করে প্রায় ৪২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। জালিয়াতি করতে কর্মকর্তারা একে অপরের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এমন জালিয়াতির চিত্র উঠে এসেছে। জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় ব্যাংকটির গুলশান শাখার ছয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের (ঢাকা-১) সহকারী পরিচালক আজিজুল হক বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
এজাহারে বলা হয়, আসামিরা প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটির সিস্টেম লেনদেনের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এফডিআর, এসডিএস, এসএনডিসহ বিভিন্ন সঞ্চয়ী খাতের মুনাফাসহ ওইসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখার বিভিন্ন গ্রাহকের নামে থাকা চারটি এফডিআরে জমা এক কোটি ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ১২২ টাকা, ২২টি পে-অর্ডারের দুই কোটি ৭৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩১২ টাকা এবং ৫৯ গ্রাহকের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব থেকে ৬১৩টি চেক এবং একটি ক্রেডিট ভাউচারের ৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার ৪৩৫ টাকা। এভাবে মোট ৪২ কোটি ৩৭ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৯ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন তারা। এক্ষেত্রে আসামিরা সিস্টেম লেনদেনের আইডি ও একে অন্যের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মামলার বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে বলতে পারব।’
অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবের খাত (জিএল হেড) থেকে টাকা বিভিন্ন নামের হিসাবের খাতে স্থানান্তর করে এফডিআর হিসাবে এনে নগদায়ন করা হয়। হিসাব খোলার সময়ে আবেদন ফরম ছাড়াই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একটি এফডিআরের বিপরীতে আবেদন ফরম পাওয়া গেলেও কোনো মোবাইল নম্বর দেয়া হয়নি। তাই তার সঙ্গে যোগাযোগও করা যায়নি। এভাবে চারটি এফডিআর হিসাব অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামে খোলা হয়েছিল। হিসাব খোলার পরপরই তা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেনÑপ্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখার বরখাস্ত হওয়া অপারেশন ম্যানেজার এসভিপি এএম ওমর খসরু, সাবেক এসইও অ্যান্ড জেনারেল ব্যাংকিং অফিশিয়াল আকবর হোসেন, সাবেক জেএভিপি অ্যান্ড জিবি ইনচার্জ কাজী কাওসার হোসেন, সাবেক জেএভিপি অ্যান্ড ইমপোর্ট ইনচার্জ সাহেদ হোসেন, সাবেক জেএডিপি অ্যান্ড রিলেশনশিপ ম্যানেজার মঞ্জুর হাসান ও সাবেক জুনিয়র অফিসার (বৈদেশিক বাণিজ্য) রুহুল আমিন।
ঢাকার বনানী সুপার মার্কেটের ‘পিকচার সেন্টার ডিজিটাল কালার ল্যাব অ্যান্ড স্টুডিও’র নামে পরিচালিত হিসাব থেকে ৭৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শহীদুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি ২০২০ সালে ফটো পার্ক নামে নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করেছি। ওই প্রতিষ্ঠানটি আমার নয়। সেটির মালিক নাসির উদ্দিন থেকে আমরা শুধু ছবির ব্যাকআপ (আর্কাইভ) কিনে রেখেছি।’ পরে নাসির উদ্দিনের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, টাকা জমাদানের রশিদ ছাড়াই ‘গ্রীন শক্তি’র নামে দুই কোটি ৭৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩১২ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এছাড়া আসামিরা রিলেশনশিপ ম্যানেজার হিসেবে ব্যাংকের কিছু হিসাবধারীদের চেকবই তাদের কাছে জমা রাখতেন। সেসব চেকবই ব্যবহার করে ইশা ফ্যাশন অ্যান্ড মামার স্টোরের নামে ১১ লাখ টাকা, মাহমুদা মোস্তাকিমার নামে ৬২ লাখ ৬৮ হাজার, মোজাম্মিল হোসেনের নামে ২০ লাখ ১১ হাজার, আব্দুল করিমের নামে ২৬ লাখ, তানিম হোসেনের নামে ১ কোটি ২৮ লাখ ৩৬ হাজার, মারুফের নামে পাঁচ লাখ, রবিউল আওয়ালের নামে ৭৪ লাখ ৩৯ হাজার, মুক্তা আক্তারের নামে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০, আব্দুল মোতালেবের নামে ৪৫ লাখ ৭০ হাজার, আমজাদ হোসেনের নামে সাত লাখ ৪৩ হাজার ৬০০, আনোয়ার হোসাইনের নামে ৫২ লাখ ১৩ হাজার, শাহাদত হোসেনের নামে ৩৯ লাখ, মেসার্স আলম এন্টারপ্রাইজের নামে ৬২ লাখ দুই হাজার, ইরশাদ আলীর নামে ৫৬ লাখ ৩২ হাজার, নামিরা ইন্টারন্যাশনালের নামে এক কোটি এক লাখ ৭৬ হাজার, বাবুল হোসেনের নামে ৩৭ লাখ ৫১ হাজার, নাহিদ আফরোজের নামে ৩২ লাখ ৪৮ হাজার, মীর শামসুল আলম অ্যান্ড নাসিমা আক্তারের নামে ২১ লাখ ৫০ হাজার, ফকরুল ইসলামের নামে ২৫ লাখ ৫০ হাজার, এনএ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ২৭ লাখ ৫৪ হাজার, মেসার্স মাসুদুর রহমানের নামে এক কোটি ২৯ লাখ ৬৯ হাজার ২০০, সানবিম করপোরেশনের নামে সাত লাখ, মেসার্স জালালাবাদ এন্টারপ্রাইজের নামে এক কোটি ৫৬ লাখ ৪৪ হাজার, মিজানুর রহমানের নামে ১০ লাখ, মাহমুদ হোসেনের নামে দুই কোটি ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার, কাজী রাজিয়া সুলতানার নামে ৪২ লাখ, তাসকিরা আহমেদের নামে ৬৫ লাখ পাঁচ হাজার, মুসলিমা এন্টারপ্রাইজের নামে ৮৮ লাখ এক হাজার, মেসার্স হাই কনস্ট্রাকশনের নামে এক কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার, পিকচার সেন্টার ডিজিটাল কালার ল্যাব অ্যান্ড স্টুডিও’র নামে ৭৬ লাখ ৮৯ হাজার, আবু নোমান রাসেলের নামে ৫৩ লাখ ৯১ হাজার, আব্দুল হকের নামে ৬ লাখ, শরীফ উল্লাহ মীরের নামে ২৮ লাখ, নাদিয়া মামুন এশার নামে ২২ লাখ ৭৭ হাজার, মমতাজ শাহনাজের নামে ১৯ লাখ ২০ হাজার, মেসার্স এসএইচ এন্টারপ্রাইজের নামে ২৪ লাখ ৩০ হাজার, মেসার্স নাসির এন্টারপ্রাইজের নামে ৯ লাখ ৩৪ হাজার, মুরাদ হোসাইন ফাহাদের নামে ৮৩ লাখ ৮৫ হাজার, গ্লোবাল ট্রেডিং কোংয়ের নামে ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৩১৯ টাকা, জেড গার্ডেনের নামে ৬০ হাজার, গোলাম রব্বানীর নামে ২৮ লাখ ৮৭ হাজার, এএম ওমর খসরুর নামে সাত লাখ ৪০ হাজার, নাজুফা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ১৫ লাখ ৩১ হাজার, শাহানা বেগমের নামে ২১ লাখ ২৪ হাজার, আব্দুল হাই হাওলাদারের নামে ৪১ লাখ ৬০ হাজার, ছাদিকুন নাহার ডলির নামে ৯ লাখ ৫১ হাজার, মাসুদ আহমেদ সরকারের নামে ২০ লাখ, আছমা আক্তারের নামে ১৫ লাখ ৩২ হাজার, ইমাম রাসেলের নামে এক কোটি ৩১ লাখ ৩৯ হাজার, টিডিএম কমিউনিকেশনের নামে এক কোটি দুই লাখ ২৬ হাজার ৮১৬ টাকা, হোসনে আরা হাসানের নামে এক কোটি ২৭ হাজার, কাজী সুমাইয়ার নামে ২১ লাখ ৫৬ হাজার, ইমতিয়াজ আলী জিমির নামে ৩৩ লাখ ৩২ হাজার, নাজ এন্টারপ্রাইজের নামে দুই কোটি ৯৪ লাখ ৪৫ হাজার, মিসেস নাজমা পারভীনের নামে ৫৫ লাখ ৬০ হাজার, রানা মাল্টিমিডিয়ার নামে তিন কোটি ৩৮ লাখ ৫৮ হাজার, তাসলিমা আক্তারের নামে ৫৭ লাখ, সিদ্দিকুর নাহার ডলির নামে তিন লাখ, ফারুকুল ইসলামের নামে তিন লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে কোনো প্রতিষ্ঠান এবং আরও কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সেসব আমলে নেয়া হবে।