প্রেরিত রেমিট্যান্স ও বিনিময়ে প্রাপ্তি

তারেক মিয়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কভিড মহামারির চলমান সংকটেও প্রবাসীদের আয়ের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমান অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম মাস জুলাইয়ে রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এরপর আগস্টে ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে প্রবাসী আয় হয়েছিল ৪৫১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। দেশের জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভারসম্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

দেশের উন্নয়নে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া প্রবাসীরা বিনিময়ে কী পাচ্ছেন? একজন প্রবাসী দিনরাত পরিশ্রম করে নিজের জীবনকে বিসর্জন দিয়ে পরিবার ও দেশের সুখ কিনতে পাড়ি জমাচ্ছেন দূর প্রবাসে। অথচ দেখা যায়, পরিবার ও প্রিয় জš§ভূমিকে সুখে রাখতে গিয়ে নিজেই সুখের বৃত্ত থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন, কষ্টকে আলিঙ্গন করে বেঁচে আছেন বছরের পর বছর।

বর্তমানে ১৭৪টি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বসবাস করছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ। সৌদি আরবে রয়েছেন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি, প্রায় ১২ লাখ। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, কোরিয়া, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের বসবাস রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। যদিও আইএলও’র মতে, দেশে কর্মক্ষম প্রায় চার কোটি ৮২ লাখ মানুষ কর্মহীন। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশে প্রর্যাপ্ত কাজের সুযোগ নেই। বিশাল এই বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংসস্থান করতে পারলে তাদের বিদেশ-বিভুঁইয়ে আসার প্রশ্নই ছিল না। অনেকটা নিরুপায় হয়েই লাখ লাখ কর্মী বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আসছেন প্রবাসে। অথচ এখানে এলে শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। নতুন পরিবেশ তাকে শিখিয়ে দেয় নতুন করে বাঁচতে শেখা। 

প্রবাসে সফলতার চূড়ায় আহরণ করেছেন, এমন প্রবাসীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। বিদেশে প্রবাসীরা যখন কোনো বিপদে পড়েন, আইনি ঝামেলায় পড়েন বা কোনো কারণে আহত ও অসুস্থ হয়ে থাকেন, তখন দূতাবাসগুলোর কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না। সহায়তার জন্য দূতাবাসগুলোর দ্বারস্থ হলে হতে হয় অপমানিত। প্রবাসীরা কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স দেশে পাঠান, কিন্তু কোনো কর্মী মারা গেলে লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য তার পরিবার নামমাত্র কিছু অর্থ পায়। এছাড়া ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু পরিমাণ টাকা পেয়ে থাকেন অনেকেই। তবে যে দেশে তিনি মারা যান, সেই দেশে কর্মক্ষেত্রে মারা গেলে কী ক্ষতিপূরণ আছে, তা জানতে বা সেটা আদায় করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। প্রবাসীরা মারা গেলে লাশ দেশে পাঠানোর জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। প্রবাসীরা কখনও কখনও চাঁদা তুলেও লাশ দেশে পাঠান। অথচ আমাদের দূতাবাসগুলো খবরও রাখে না। দূতাবাসগুলো আমাদের মতো প্রবাসীদের পাশে না থাকায় ওইসব দেশের কর্তৃপক্ষও প্রবাসীদের প্রাপ্ত সম্মান বা মর্যাদা দেয় না বললেই চলে।

প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার থাকে না। এই ব্যাংকটি মূলত করা হয়েছিল যারা বৈধভাবে বিদেশে কাজের জন্য যাবেন এবং যারা ফিরে আসবেন, তাদের ঋণ সহায়তা দেয়ার জন্য। কিন্তু এই ব্যাংক আসলে প্রবাসীদের পাশে যথাযথভাবে  দাঁড়াতে পারেনি। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক একজন কর্মীকে বিদেশে যেতে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ টাকা ঋণ দেয়, ওই টাকায় কোনো কর্মীর বিদেশ যাওয়া হয় না। আবার ঋণ নিতে গ্যারান্টারসহ কাগজপত্রের নানা জটিলতাও পোহাতে হয়। সুদের হারও কম নয়। অথচ সরকারের উচিত ছিল প্রবাসীদের জন্য বিনা সুদে বা নামমাত্র সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা। এখান থেকে চাহিদামতো ঋণও পান না প্রবাসীরা ।

কোনো কর্মীকে বিদেশ পাঠানোর আগে সবকিছু কনফার্ম (নিশ্চিত) করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএমইটি। তারপর সেই কর্মী ঠিকমতো বেতন না পেলে এবং নিয়োগকারী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান শ্রম আইন না মানলে সরকারের উচিত তাকে সহায়তা করা। তাছাড়া দেখা যায় কাজের অনুমতিপত্র বা ইকামা নিয়েও পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের গাফিলতির শিকার হয়ে কাজের অনুমতিপত্র পান না অনেকেই। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে যে কয়টা টাকা তারা উপার্জন করেন, তাও পেতে চলে নানা রকমের বাহানা।

প্রবাসীদের নিয়ে কটূক্তি ও অসম্মান করার প্রবণতাও বেড়ে গেছে ব্যাপকহারে। এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেখা গেছে কভিডকালে। এমনকি প্রবাসীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন এমপি-মন্ত্রীরাও। তাদের দায়িত্বহীন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি যন্ত্রণাদায়ক ও দুঃখজনক। এমন অবিচার-অবমূল্যায়ন কি চলতেই থাকবে? প্রবাসীদের কষ্ট কি কেউ বুঝবে না? আমরা বিশ্বাস করি, দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা প্রবাসীদের পাশে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। প্রবাসীদের অপ্রাপ্তি-ভোগান্তি দূরীকরণে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রবাসী শ্রমিক

দাম্মাম, সৌদি আরব