সিএনএন থেকে ভাষান্তর আহ্মদ ইকরাম আনাম : ৯০০ কোটি লোকের জন্য আমরা কীভাবে পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী ও স্বাস্থ্যসম্মত আমিষের ব্যবস্থা করবো?
এ কঠিন প্রশ্নের উত্তরও সহজ নয়। তবে ব্যবসায়ী, পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ ও সরকারি সংস্থার এক অনন্য জোট এর উত্তর খোঁজার জন্য ‘প্রোটিন চ্যালেঞ্জ-২০৪০’ নামক একটি উদ্যোগ নিয়েছে।
বর্তমানে আমিষের ওপর আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যক, কিন্তু যে উপায়ে আমরা এর উৎপাদন জোগাচ্ছি ও খাচ্ছি, তা পৃথিবী তো বটেই, মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।
আমরা মাংসনির্ভর খাবারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং জনসংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি করে চলেছি। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের যাবতীয় নেতিবাচক প্রভাব হিসাব করলে যে পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তাতে এখনই ঘুরেদাঁড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্রোটিন চ্যালেঞ্জ-২০৪০ সেকথাই বলছে আমাদের।
প্রাণিসম্পদকে বেশি বেশি আমিষ খাওয়ানো হচ্ছে আমরা এমন এক অদ্ভুত দুনিয়ায় বাস করি, যেখানে উচ্চমানের উদ্ভিজ্জ আমিষের (গম, সয়া প্রভৃতি) ৫০ শতাংশ খাওয়ানো হয় গবাদিপশুকে, যা মানুষকেই খাওয়ানো যেতো।
তাছাড়া খামারের বাইরে প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মানো মাছের এক বিরাট অংশ আমরা খামারের পশু, নইলে অন্য মাছকেই খাওয়াই। তাই পশুখাদ্যের জন্য যে আমিষ দরকার, তা এখন সয়াবিন গাছের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করা শুরু করেছে। আর এত সয়াবিন গাছ চাষের জন্য ক্রমান্বয়ে উজাড় করতে হচ্ছে বনাঞ্চল।
এখন আসলে শস্য উৎপাদনের অধিকতর স্থায়ী সব কলাকৌশল আবিষ্কারের দিকে না গিয়ে এর বিকল্প খুঁজতে হবে; কমাতে হবে চাহিদাও।
পুরো বিষয়টি আরও জটিল। আমাদের কেউ কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণ করে থাকে। ২০০ কোটির মতো মানুষ স্থূলকায়।অন্যদিকে বহু মানুষ প্রয়োজনীয় আমিষ পাচ্ছে না। বিশ্বে ৭০ কোটি মানুষ ভুগছে ক্ষুধার যন্ত্রণায়।
এ দুই পক্ষই কিন্তু নিদারুণ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে। কিছু আমিষের রয়েছে উচ্চ পুষ্টিগুণ। আর প্রাণিজ আমিষের পেছনে ব্যয়ও যেমন বেশি, তেমনি পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব বিদ্যমান। যেমন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ, অতিরিক্ত পানির ব্যবহার ও মূল্যবান প্রাণিসম্পদের একাংশকে চিরতরে হারানো।
উদ্ভিদ থেকে বেশি আমিষ জোগানো এখনই বলছি না, আমরা সব উত্তর পেয়ে গেছি। তবে অনুসন্ধানী সব গবেষণা আর দুই শতাধিক অংশীজনের সঙ্গে কাজ করে আন্তর্জাতিক টেকসই উন্নয়ন সংস্থা ‘ফোরাম ফর দ্য ফিউচার’র সহায়তায় আন্তর্জাতিক প্রোটিন চ্যালেঞ্জ-২০৪০ দল এখন তিনটি ক্ষেত্রে কাজ করছে।
এমন পদ্ধতিতে এগোতে হবে, যা এ সমস্যার বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করে আমাদের ক্রমান্বয়ে লক্ষ্য অর্জনের দিকে ধাবিত করবে।
প্রথম লক্ষ্য হবে, নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় উদ্ভিজ্জ আমিষের পরিমাণ বাড়ানো। এর মধ্যে অবশ্যই সুস্বাদু বিকল্পকেই আমরা বেছে নিতে চাইবো।
পশ্চিমা দেশগুলোতে অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ ভক্ষণ করা হয়। আজকাল তা উন্নয়নশীল দেশ চীন ও ভারতেও গুণোত্তর ধারায় বাড়ছে।
দীর্ঘদিনের এ খাদ্যাভ্যাস বদলানো এত সহজ নয়। প্রতিবেলার খাবারে মাংসকেই আমরা মূল খাবার হিসেবে বেছে নিয়েছি। অল্পস্বল্প শাকসবজি সেখানে উপস্থিত থাকলেও তাতে আমিষের পরিমাণ তেমন একটা থাকে না। আর সবজি খেতেও আমরা তেমন একটা পছন্দ করি না। অবশ্য ইতোমধ্যে বাবুর্চি, খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করে আমরা বেশি বেশি উদ্ভিজ্জ খাবারের রেসিপি ও খাদ্যপণ্য তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে ঘরের বাইরে গেলেও মানুষ উদ্ভিজ্জ মজাদার ও প্রয়োজনীয় আমিষযুক্ত খাবার খেতে পারে।
টেকসই পশুখাদ্য
অধিকতর টেকসই পশুখাদ্যের সন্ধানও চলছে। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খামারের গরু-ছাগল, মুরগি, শূকর ও মাছকে শস্যদানা, সয়াবিন, মাছের খাদ্য খাওয়ানো হয়েছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এসব খাবারের অনেকগুলোই উচ্চ আমিষযুক্ত, যা সহজেই মানুষকে খাওয়ানো যেতো, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে তারা নিদারুণ আমিষ ঘাটতিতে ভুগছে।
আবার পশুকে খাওয়ানোর জন্য আমরা যে মাছ ব্যবহার করি, সেগুলো কিন্তু সামুদ্রিক বাস্তুব্যবস্থাকে চাপের মুখে ফেলে দেয়। পশুখাদ্যের নতুন উৎস (পোকামাকড়, ঘাসলতা, কলাই বা শুঁটি প্রভৃতি) প্রয়োগ করাও দুষ্কর। বর্তমানে পশুখাদ্যশিল্প সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে এমন একটি নির্দেশনা টুল তৈরির চেষ্টা চলছে, যা তারা সহজেই বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী বিকল্প খাদ্যের দিকে অগ্রসর হবে।
অপচয় কমানো
সবশেষে আমরা আমিষব্যবস্থায় খাদ্যের অপচয় রোধ করার কঠিন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বে মোট উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের ৩০ শতাংশ স্রেফ নষ্ট হয়, যার অধিকাংশকেই আমিষের উৎস হিসেবে কাজে লাগানো যেতো। নতুন কিছু উপায় বের করার চেষ্টা চলছে, যাতে নতুন উদ্যোক্তারা আমিষের অপচয় রোধ করতে সক্ষম হন এবং যেটুকু আমিষ নষ্ট হয়েছে, সেটুকু পুনরায় ব্যবহার করে নতুন খাদ্যপণ্য উৎপন্ন করতে পারেন।
একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ শুধু পরিবেশগত সংকটের সম্মুখীন নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে এক বিরাট জনস্বাস্থ্য সংকটেরও মুখোমুখি যার কেন্দ্রে রয়েছে আমিষ ঘাটতি। পারস্পরিক সহযোগিতামূলক জোটের মাধ্যমে তারা এর সমাধান খুঁজে বের করতে পারেন আর প্রোটিন চ্যালেঞ্জ-২০৪০ তারই সূচনা করেছে।
ফোরাম ফর দ্য ফিউচারের
টেকসই খাদ্য কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়ক