প্লাস্টিক দূষণ এবং পরিবেশ অঙ্গীকার

পাভেল পার্থ : মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষায় তার অবস্থানকেও স্পষ্ট করে। ‘ম্যানেজিং প্লাস্টিকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সম্মেলনে তিনি প্লাস্টিক দূষণ ও করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে তিনি জানান, বাংলাদেশের সমান আয়তনের প্লাস্টিক জমা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। প্লাস্টিক নিয়ে ভবিষ্যতে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত। প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি (সূত্র: যমুনা টিভি, ৩০-১০-২৩)। বঙ্গোপসাগরকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সবার প্রতি সচেতনতার এই আহ্বান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এমনকি প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে সবার প্রতি তার আহ্বানটিও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য গুরুত্ববহ। আমরা আশা করব, প্লাস্টিকবিরোধী তৎপরতাকে তিনি সক্রিয় রাখবেন। একইসঙ্গে প্লাস্টিকমুক্তকরণের জন্য তার আহ্বান ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন না। কারণ পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষায় ঘোষিত বৈশ্বিক অঙ্গীকারগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো বারবার ভঙ্গ করছে। প্লাস্টিকমুক্ত এক সবুজ আগামী গড়তে আমরা রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে সঙ্গে পাব আশা করি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। কারণ বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের জন্য তারই দেশ এবং দেশের নানা করপোরেট কোম্পানিগুলো দায়ী। একইসঙ্গে অধিক কার্বন নিঃসরণ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যও দায়ী তার দেশ শীর্ষসারিতে আছে। এতসব দায় নিয়ে একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্লাস্টিকবিরোধী স্বপ্নযাত্রার অঙ্গীকার অবশ্যই পরিবেশ সুরক্ষার বার্তা দেয়। একইসঙ্গে রাষ্ট্রদূতের প্লাস্টিকবিরোধী এই বার্তা আমাদের সামনে আরও নানা অমীমাংসিত প্রশ্ন ও তর্ককেও হাজির করে। প্লাস্টিক নিয়ে বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তৎপরতায় আশা করি, আমরা সম্মানিত রাষ্ট্রদূতকে সক্রিয়ভাবেই পাব।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির এক সূত্র (২০২২) অনুযায়ী, ১৯৫০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ৯.২ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে। ১৯৫০ সালে ২.৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়; যা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৪৮ মিলিয়ন টন (সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক)। পৃথিবীর জনসংখ্যার মোট ওজনের সমান প্লাস্টিক প্রতি বছর উৎপাদিত হয় (সূত্র: আর্থডে)। দুনিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন পলিথিন সামগ্রী তৈরি হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক উৎপন্ন করে এবং প্লাস্টিক দূষণ ঘটায়। ‘প্লাস্টিকস ইউরোপের (২০২০)’ সূত্রমতে, চীন একাই ৩১ শতাংশ প্লাস্টিক উৎপাদন করে, নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (নাফটা চুক্তি) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে আমেরিকা, কানাডা ও মেক্সিকো উৎপাদন করে ১৯ শতাংশ, ১৭ শতাংশ উৎপাদিত হয় এশিয়ায়, ইউরোপ ১৬ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা করে ৭ শতাংশ এবং জাপান উৎপাদন করে ৩ শতাংশ প্লাস্টিক। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ১.২ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল ব্যবহƒত হয়। ৯১ শতাংশ প্লাস্টিকই আর পুনর্ব্যবহƒত হয় না। একজন মার্কিন নাগরিক মাসে ১৩টি পানির বোতল ব্যবহার করে এবং বছরে আমেরিকার জনগণ ৫০ বিলিয়ন প্লাস্টিক পানির বোতল ক্রয় করে। পৃথিবীতে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপন্ন হয়। প্রতিদিন আমেরিকাতেই অর্ধ বিলিয়ন প্লাস্টিক স্ট্র পানীয় পানে ব্যবহƒত হয়। পৃথিবীতে বছরে ৫০০ বিলিয়ন প্লাস্টিক কাপ ব্যবহƒত হয় (সূত্র: ডাবিøউডাবিøউডাবিøউ ডট আর্থডে ডট ওআরজি)। আমেরিকায় বছরে ১০০ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহƒত হয়, যা তৈরিতে ১২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল লাগে (সূত্র: ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড, ২০১৯)। প্রতিজন মার্কিন নাগরিক বছরে ৩৬৫টি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে এবং একজন ডেনমার্কের নাগরিক বছরে চারটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে (সূত্র: এলেনম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশন, ২০১৭)। আমরা জানি, প্লাস্টিক দূষণ বিষয়ে এসব অতিসাধারণ খতিয়ান সম্মানিত রাষ্ট্রদূতের জানা আছে। প্লাস্টিক দূষণ সর্বময় সংযুক্ত। এটি করপোরেট ভোগবাদিতার সঙ্গে মিশে আছে। বাংলাদেশকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্লাস্টিক দূষণকেও প্রশ্ন করা জরুরি। মার্কিন করপোরেট বাহাদুরি এবং নয়াউদারবাদী ভোগবাদকে প্রশ্ন করতে হবে। তা না হলে কি বিশ্ব প্লাস্টিকমুক্ত হবে?

বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে আমাদের আন্তঃসীমান্ত নদীপ্রবাহের মাধ্যমে এ নিয়ে বাংলাদেশের এক বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসডো ‘দ্য ট্র্যাজিক টেলস অব আওয়ার রিভারস: প্রসপেক্টস টু প্রবলেম’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বিপজ্জনক বার্তা প্রকাশ করেছে। এসডো তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, দেশের ১৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ৩৪৫ টন একবার ব্যবহƒত প্লাস্টিক বর্জ্য বহন করে। বছরে প্রায় ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। নদী, সাগর, জলাভ‚মি দূষণকারী এই প্লাস্টিকের অধিকাংশই কোক-পেপসির বোতল কিংবা কোনো না কোনো কোম্পানির একবার ব্যবহার্য সামগ্রী।

ডাও কেমিক্যাল, লায়নডেল বেসেল, এক্সন মবিল, এসএবিআইসি, বিএএসএফ, সিবুর, স্যিন-এস্টু কেমিক্যাল, ইন্দরামা ভেনচারস, সিনোপ্যাক, ব্রাসক্যাম পৃথিবীর শীর্ষ প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কোম্পানি। প্লাস্টিকবিরোধী আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ‘ব্রেক ফ্রি ফ্রম প্লাস্টিক’ করপোরেট প্লাস্টিক দূষণবিষয়ক তাদের তৃতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর। এই সমীক্ষা তৃতীয়বারের মতো প্রমাণ করেছে কোক-পেপসি এবং নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমেই দুনিয়ায় ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। পৃথিবীর ৫৫টি দেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবী তিন লাখ ৪৬ হাজার ৪৯৪টি প্লাস্টিক নমুনা সংগ্রহ করেন। দেখা গেছে, এগুলো প্রায় সবই কোনো না কোনো কোম্পানির পণ্যের বোতল, মোড়ক ও ধারক। কোক-পেপসি বাদে প্রতিবেদনে চিহ্নিত শীর্ষদশের অন্য প্লাস্টিক দূষণকারী কোম্পানিরা হলোÑইউনিলিভার, মনডেলেজ ইন্টারন্যাশনাল, মারস, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, ফিলিপ মরিস, কোলগেট-পালমোলিভ ও পারফেট্টি। রাষ্ট্রদূত নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবেই জানেন, মুমূর্ষু প্রকৃতিকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে হলে অবশ্যই কোক-পেপসিসহ বহুজাতিক কোম্পানিকে প্রশ্ন করতে হবে। পরিবেশগত জবাবদিহিতা ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী শীর্ষ কোম্পানিরা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখন এই প্রশ্ন করার কায়দা একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে কেমন হতে পারে? কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পিটার হাস প্রাণ, প্রকৃতি ও সবুজ অর্থনীতির সপক্ষে। অবশ্যই তিনি বহুজাতিক প্লাস্টিক দূষণকে প্রশ্ন করে দাঁড়াবেন। বাংলাদেশ ও আমেরিকাসহ পৃথিবীকে প্লাস্টিকমুক্ত সবুজায়নের আন্দোলনকে সক্রিয় করতে ভ‚মিকা রাখবেন।

রাষ্ট্রদূতের নিশ্চয়ই জানা আছে, বাংলাদেশ প্রথম আইনত পলিথিন নিষিদ্ধ করে। প্লাস্টিক দূষণ রোধে দশ বছর মেয়াদি এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৯২টি মামলা দায়ের করেছে। সুন্দরবনে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ২০২১ প্রণয়ন করেছে। ২০২৬ সালের ভেতরে দেশকে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকমুক্ত করতে লক্ষ্য অর্জনে প্রথম ধাপে সব সরকারি দপ্তরে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ নেয়ার কথা জানা গেছে। জানি, রাষ্ট্রদূত প্রশ্ন করতে পারেন তবে কেন বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ থামছে না? অবশ্যই এক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা, উদাসীনতা, পরিবেশ-দুর্নীতি, ভোগবাদিতা এবং বাণিজ্য মুনাফার বিষয়গুলোও প্লাস্টিক দূষণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক প্লাস্টিকময় ভোগবাদ এবং নয়াউদারবাদী বাণিজ্য বিস্তার বাংলাদেশেও প্লাস্টিক দূষণকে জিইয়ে রেখেছে। প্লাস্টিক রোধে আসলেই আমাদের সবাইকে সক্রিয় হতে হবে। নিজের দায় ও দায়িত্ব বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে আমরা আমাদের বন্ধুমহল, আত্মীয়-পরিজন, গ্রাম-শহর, সমাজ ও দেশে প্লাস্টিককে ‘না’ বলা চর্চা করতে পারি। আশা করব মার্কিন রাষ্ট্রদূতও এই চর্চায় শামিল হবেন। মার্কিন দূতাবাসেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হবে। পাহাড় থেকে বঙ্গোপসাগর কোথাও জমবে না কোক-পেপসির প্লাস্টিক বর্জ্যরে স্তুপ।

লেখক ও গবেষক