উম্মে সাবাইনা সুলতানা: গত শতকের আশির দশকে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার শুরু হয়। দেখতে আকর্ষণীয় ও স্বল্প মূলে্যর কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভোক্তাদের কাছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাতীয় পণ্যের ক্ষতিকর দিক চিন্তা করে ২০০২ সালে বাংলাদেশে প্রথম আইন প্রণয়ন করে প্লাস্টিক পণ্য ‘পথিলিন’ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই অগ্রগামী উদ্যোগ তখন বাস্তবায়ন করা হয়নি। ওজনে হালকা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ার কারণে প্লাস্টিক পণ্য ভোক্তাদের বেশি পছন্দের কারণ হয়। এজন্য প্লাস্টিক বর্জনের অভিনব নীতি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
আধুনিক বিশ্বে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থে্যর জন্য মারাত্মক হুমকি হলো প্লাস্টিকদূষণ। তাই পরিবেশের সুরক্ষার জন্য প্লাস্টিক বর্জন করা অত্যন্ত আবশ্যক। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার দ্বিতীয়বারের মতো বাজারে পলিথিন বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই সময় ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন ব্যাগ ছাড়াও আমাদের দেশে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি বালতি, বোতল, গ্লাস, চামচ, দড়ি, খেলনা ইত্যাদি জিনিসপত্র দেখা যায়। প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পরিবেশগত সমস্যা বাড়ছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হলো প্লাস্টিকদূষণ রোধ করা। শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী ও স্বল্প মূল্যের কারণে প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য সাধারণ মানুষের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। প্লাস্টিক ও পলিথিন সহজে পচে না। এই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হলে তা মাটির সঙ্গে মিশতে সময় নেয় প্রায় সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ বছর। এমনকি মাটির অনেক নিচে যাওয়ার পর এসব প্লাস্টিক পণ্য ধ্বংস করছে মাটির স্বাভাবিক স্তরকে। পলিপ্রোপিলিন ব্যাগে থাকা রাসায়নিক পদার্থ মাটির জীব, গাছ, মাটির উর্বরতা, কৃষি উৎপাদনশীলতা সবকিছু ধ্বংস করে। প্লাস্টিক বর্জে্যর একটি বড় অংশ জলাশয় ও নদীতে ফেলা হয়। বুড়িগঙ্গা ও যমুনা নদীসহ বাংলাদেশের নদ-নদী প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এতে জলজ জীবের ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া ডাস্টবিনসহ বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়া পলিথিন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদীর তলদেশও ভরাট করে ফেলে। নদী খনন করেও এর পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
প্লাস্টিকের প্রধান সমস্যা হলো এটি সহজে ও দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। প্লাস্টিক প্রাকৃতিকভাবে কয়েকশ বছর ধরে ভাঙে না। এতে মাটিদূষণ হয়ে থাকে। প্লাস্টিক মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করে, মাটিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং জলধারায় বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ছড়িয়ে দেয়, যা মাটি ও পানির গুণগত মান নষ্ট করে। এতে কৃষিজমির উর্বরতা কমে যায় এবং পানির উৎস দূষিত হয়। বড় প্লাস্টিকের জিনিসপত্রগুলো ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়, যা পানীয় উৎসগুলোয় পাওয়া গেছে। এটি মানবশরীরে জমা হয় এবং স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। পলিথিনে মোড়কজাত করা খাদ্যদ্রব্য থেকে ক্যানসারের মতো মারণব্যাধি রোগ হতে পারে। আবার এর থেকে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ও লিভারের সমস্যাও হতে পারে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও ব্যাপকভাবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা হয়। উন্নত দেশে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকার কারণে প্লাস্টিক পরিবেশে কম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং অধিক জনসংখ্যার কারণে প্লাস্টিক পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আবার আমাদের দেশে প্লাস্টিক পণ্য পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়াও জটিল।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষার জন্য আমাদের প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে। বারবার প্লাস্টিক বর্জনের ঘোষণা এলেও তা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। গত ১ অক্টোবর থেকে দোকানে পলিথিন রাখা ও ক্রেতাদের দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এই উদ্যোগ কত দিনে কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আমাদের ব্যক্তি উদ্যোগে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে। এর জন্য আমাদের প্লাস্টিকের বিকল্প দরকার। প্লাস্টিকের বিকল্প কী হতে পারে, এটা আমাদের চিন্তার কারণ নয়। আমাদের দেশে প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প আছে। আমরা প্লাস্টিক ও পলিথিনের পরিবর্তে পাটের তৈরি পণ্য ব্যবহার করতে পারি। বাংলাদেশে পাটের তৈরি পণ্যের একটি গৌরবময় অধ্যায় রয়েছে। পাটকে একসময় সোনালি আঁশ বলা হতো। এটি আমাদের দেশের প্রধান অর্থনৈতিক ফসল ছিল এবং অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। সেসময় পাট আমাদের অর্থনীতি সচল করে রেখেছিল। কিন্তু সত্তর ও আশির দশকে বিশ্বব্যাপী পাটের চাহিদা কমে যেতে থাকে। অন্যদিকে প্লাস্টিক ও সিনথেটিক উপাদান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে বাংলাদেশের পাটশিল্পও সংকটে পড়ে। বর্তমানে পরিবেশবান্ধব পণ্যের দিকে আগ্রহ বাড়ার ফলে আবার পাটশিল্পের গুরুত্ব বাড়ছে। পাট থেকে এখন কাগজ, ব্যাগ, টেক্সটাইলসহ নানা ধরনের পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি হচ্ছে।
এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদা রয়েছে। এক্ষেত্রে বলা যায়, প্লাস্টিক ও পলিথিনের পরিপূরক হলো পাট থেকে তৈরি ব্যাগ ও বিভিন্ন পণ্য, যা পরিবেশবান্ধবও। ২০১৬ সালে পাট থেকে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন করা হয়। সোনালি ব্যাগ প্রচলিত পলিথিন ব্যাগের মতো দেখতে পাতলা ও টেকসই। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাটের তৈরি পণ্যকে জলরোধী করা যায়, যা প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে খুব সহজে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া পাট থেকে তৈরি একটি ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে। এটি মাটিতে ফেললে সহজে মাটির সঙ্গে মিশে পচে যায়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে। সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকীকরণ করলে পাটচাষিরা উপকৃত হবে এবং পাট চাষ বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে সোনালি ব্যাগের উৎপাদন শুরু হলে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যাবে। পাট থেকে সোনালি ব্যাগের ব্যবহার শুরু হলে যেমন পরিবেশের জন্য ভালো হবে, তেমন এতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। পাটচাষিরা ন্যায্যমূল্য পাবে এবং পাট উৎপাদনে উৎসাহিত হবে। সোনালি ব্যাগ ব্যবহার ও পাটের তৈরি পণ্য পাটশিল্পের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে পারবে। পাটজাত পণ্যের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দেশের হারানো ঐতিহ্যকে আবার জাগিয়ে তোলা যাবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাগজের তৈরি ব্যাগ বা কাপড়ের তৈরি ব্যাগও ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্লাস্টিক পণ্য যেমন মানুষের জন্য ক্ষতিকর, তেমন সামুদ্রিক প্রাণী ও পাখিদের জন্য সমানভাবে ক্ষতিকর। প্লাস্টিক পণ্যের ফলে জলজ প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে অনেক জলজ প্রাণী ও পাখি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক পণ্য সর্বাধিক ব্যবহার করা হয়। এজন্য হঠাৎ করে আমাদের জীবন থেকে প্লাস্টিক বাদ দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পরিবেশের সুরক্ষার কথা ভেবে আমাদের প্লাস্টিক বর্জন করা উচিত। প্লাস্টিক পণ্য বর্জনের জন্য কঠোরভাবে আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইন অমান্যকারীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়