Print Date & Time : 6 July 2025 Sunday 10:00 pm

ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরে কী বার্তা পেল বাংলাদেশ?

নোমান বিন হারুন:তিন দশক পর বেশ আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। বাংলাদেশ-ফ্রান্স দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ পুরোনো এবং ঐতিহাসিক। ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে ফ্রান্স বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ১৭ মার্চে প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সতেরো শতকে ফরাসি বণিকদের তৎকালীন বাংলায় আগমনের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কের সূচনা হয় তারই ধারাবাহিকতা যেন এখনও অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থে। ফ্রান্সে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের আড়াই বিলিয়ন ডলারের একটি বড় বাজার রয়েছে; যা ভারত বা চীনের মোট রপ্তানির চেয়েও বেশি। বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ফ্রান্সের সহযোগিতা রয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর বাংলাদেশে আগমনের মধ্য দিয়ে এই সহযোগিতার সূচনা হয়। সেই সফরে ফ্রান্স বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্পে সাহায্য করে। বর্তমানে বাংলাদেশে পানি শোধনাগার, পরিবেশ প্রকল্পসহ বেশকিছু ফরাসি প্রকল্প ও যৌথ ব্যবসা চলমান রয়েছে। সেদেশে গার্মেন্টস, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ এগুলো রপ্তানি করে আসছে। বিপরীতে ফ্রান্স এদেশে রপ্তানি করে রাসায়নিক, সুগন্ধি, প্রসাধনসামগ্রী, ফার্মাসিউটিক্যালস ও কৃষিভিত্তিক পণ্য। বাংলাদেশে ফরাসি ব্র্যান্ডের খুব জনপ্রিয় ছয়টি পণ্য হলো লাফার্জ সিমেন্ট, টোটাল গ্যাস সিলিন্ডার, বিক রেজর, কসমেটিকস সৌন্দর্যবর্ধক প্রতিষ্ঠান গার্নিয়ার ও লরিয়েল এবং মেডিসিন প্রোডাক্ট সানোফি।

অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি, ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত সহায়তাও পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ নির্মাণ করে ফরাসি প্রযুক্তি কোম্পানি থেলিস। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু-২-এর ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। এ ছাড়া থেলিস বাংলাদেশের এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়েও এ মুহূর্তে কাজ করছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাডার ব্যবস্থা স্থাপনের কাজও চলছে তাদের অধীনে। মহামারি মোকাবিলায় ফ্রান্স বাংলাদেশকে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো লোন দিয়েছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ৫.৩৮ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন সহায়তা দিয়েছে। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিয়েও দু’দেশের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে। ফ্রান্সের কাছ থেকে নৌযান ও হেলিকপ্টারসহ সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে বাংলাদেশ। ফরাসি কোম্পানি থেকে বাংলাদেশ রাফায়েল উড়োজাহাজ কেনার চিন্তাভাবনা করছে।

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এবং ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। বিশেষ করে বাংলাদেশ ‘প্যারিস এজেন্ডা ফর পিপল অ্যান্ড দ্য প্ল্যানেট’-এর সক্রিয় সমর্থক। জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্রমবর্ধমান সংকট কাটিয়ে উঠতে ফ্রান্স বাংলাদেশকে কার্যকর সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জলবায়ু অভিযোজন-সম্পর্কিত প্রকল্পসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের কিছু প্রচেষ্টাকে ফ্রান্স সমর্থন করেছে। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনেও ফ্রান্সের সহযোগিতা পেয়েছে বাংলাদেশ। সমস্যার শুরুর দিকেই ফ্রান্স জাতিসংঘে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিল। জাতিসংঘে ভেটোক্ষমতা সম্পন্ন দেশটিকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করতে দেখা গেছে।

এবারের সফরে ঢাকা ও প্যারিস বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এবং বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি দুটির একটি হলো, ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট সংস্থার (এএফডি) মধ্যে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট। আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) চুক্তি। এছাড়া ফ্রান্সের কাছ থেকে ১০টি এ-৩৫২ নেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে সরকার। নগর পরিচালনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার ফ্রান্সের সঙ্গে ১৮৪ মিলিয়ন ইউরোর ঋণ সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এএফডি জানিয়েছে, এই রেয়াতি ঋণ নগর পরিচালনা ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করবে, যা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। নগর পরিচালনা ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা জোরদার করার জন্য সরকারের বৃহত্তর পৌর উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় এ ঋণ দেওয়া হচ্ছে। দেশের ৮৮টি পৌরসভায় পৌর প্রশাসনকে শক্তিশালী করা, রাজস্ব সংগ্রহের উন্নতি, পৌর প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ঝুঁকি সংবেদনশীল পরিকল্পনা, নারীর ক্ষমতায়ন, কংক্রিট অবকাঠামোর উন্নতি ও বস্তি এলাকায় সহায়তা উন্নত পৌর অবকাঠামো ও পরিষেবা বিধানের জন্য মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে এলজিইডি ও এএফডি শহরে দারিদ্র্য হ্রাস, শহুরে জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নতি, আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন এবং পৌরসভাকে আরও স্থিতিস্থাপক করে তুলবে আশা করা হচ্ছে।

১৯৮৭ সালের সাংস্কৃতিক সহায়তা চুক্তির পর থেকে বাংলাদেশের সমাজে ফরাসি ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ফরাসি ভাষার প্রসারের জন্য আলিয়াস ফ্রঁসেস কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ফ্রেঞ্চ জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশ কিছু বিভাগে পড়াশোনার পাশাপাশি ফরাসি ভাষা শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তরুণদের মাঝে ফরাসি সংগীত, সিনেমা এবং দর্শন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পাশাপাশি ফরাসি সমাজেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে ফ্রান্সে বাংলাদেশের কমিউনিটি বড় হচ্ছে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তখন ফ্রান্সে ১ লাখ ৪ হাজার ৪০০ বৈধ বাংলাদেশি বসবাসরত ছিলেন। ২০২৩ সালে সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে আরও বেশি হবে। প্যারিসে এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ের ওপর প্রদর্শনী হচ্ছে। ফ্রান্সে কর্মরত বাংলাদেশিরা একইসঙ্গে ফ্রান্সের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছে, সেইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সও পাঠাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর থেকে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই চলতি বছরের শুরুতে ফ্রান্সের এয়ারবাস কোম্পানি থেকে দশটি উড়োজাহাজ কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িংয়ের আধিপত্য কমাতে বাংলাদেশে বিমান বহরের জন্য এয়ারবাস কোম্পানির উড়োজাহাজ কেনার কথা বিবেচনা করছে বাংলাদেশ। ফ্রান্স বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে অনেক দিন ধরে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের বড় ২২টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। তাই প্রযুক্তি ও ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ফ্রান্স। বাংলাদেশে কৌশলগত সুরক্ষা অবকাঠামো বিনির্মাণে এবং বিমান চলাচল ব্যবস্থাপনায় উন্নত ও বিশেষায়িত কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সাইবার নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেয়ার কথাও জানিয়েছে তারা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে। সেইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক সম্পদ বাড়ানোর ব্যাপারে দুই দেশ যৌথভাবে কাজ করার কথা জানিয়েছে।

তবে ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল বাংলাদেশে ফ্রান্সের প্রতি কিছুটা নেতিবাচক ধারণাও রয়েছে। ইসলাম এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে ফ্রান্সের পতাকা এবং প্রেসিডেন্টের কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। সেই সঙ্গে ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের আহ্বানও জানিয়েছিল তারা। তখন স্পর্শকাতর বিষয়ে উস্কানি না দেয়ার পরামর্শ দিয়ে ফরাসি সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এবারের ইমানুয়েল ম্যাখোঁর ঢাকা সফরটি মূলত ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সফরের ধারাবাহিকতার ফলাফল। চলতি বছরের জুলাইয়ের শুরুতে ফরাসি নৌবাহিনীর একটি জাহাজ চট্টগ্রামে শুভেচ্ছা সফর করে এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুয়ের একটি বিবৃতিতে সামরিক ক্ষেত্রে সহায়তা বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। মূলত এসবের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের বৃহত্তর অঞ্চলে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বকেও স্বীকার করে নেয় ফ্রান্স।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এই সফরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত ভূরাজনীতিও গুরুত্ব পেয়েছে। সংবাদমাধ্যম এএফপি জানিয়েছে, ফ্রান্স তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে ‘শক্তিশালী’ করতে এবং এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বা ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’ প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে সফর করছে। দেশটি তাদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ইন্দো-প্যাসিফিকের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রভাব খাটানোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। সুপার পাওয়ারদের এই দ্বন্দ্বে নতুন বিকল্প হিসেবে এ অঞ্চলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইছে ফ্রান্স।

বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজন রয়েছে, কারণ পশ্চিম ইউরোপের এই দেশটি নতুন জোট গড়তে চায়। আফ্রিকার নাইজার ও গ্যাবনের মতো দেশগুলোয় সামরিক অভ্যুত্থান এবং পরে সেখানে ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভ দেশটিকে চিন্তায় ফেলেছে। সর্বশেষ গ্যাবনের অভ্যুত্থান ছিল গত তিন বছরের মধ্যে সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলোয় অষ্টম সামরিক অভ্যুত্থান। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্টের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি তাকে এ অঞ্চলে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ এনে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তার বিবেচনার বাইরেও ফ্রান্স বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।

ফ্রান্স বিশ্বের শীর্ষ দুটি জোট জি-৭ এবং জি-২০-এর সদস্য, যেখানে দেশটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নীতি তৈরি ও পরিবর্তনে অবদান রাখে। দেশটি জ্বালানি কোম্পানি জায়ান্ট টোটাল এনার্জিস, উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস এবং বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউস লুই ভুত্তো (এলভিএমএইচ) এবং কেরিংসহ অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সূতিকাগার। রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে রূপপুরের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে ফ্রান্স আগ্রহ দেখাতে পারে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হতে ফ্রান্সের সাহায্য প্রয়োজন হবে। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে তিন বিলিয়ন ইউরোর বেশিতে দাঁড়িয়েছে।

ভূরাজনৈতিক কারণে ঔপনিবেশিক শোষণের অভিযোগ থাকলেও ফ্রান্স মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়। ইতোমধ্যেই প্রভাবশালী ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এএফডি) বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পরিস্থিতি এবং ড. ইউনূসকে মামলায় হয়রানির ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ জানানো এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ, নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ পাঠানোর ব্যাপারে তারা আগ্রহী হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ড. ইউনূস ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মাননা লেজিওন ডি’অনার পাওয়া ব্যক্তি। তিনি ফ্রান্সের অভিজাত সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। ২০১১ সালে যখন এই নোবেল বিজয়ীকে গ্রামীণ ব্যাংকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়, তখন ফ্রান্স গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি সেসময় ড. ইউনূসের প্রতি লিখিতভাবে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি ফ্রান্স জাতিসংঘের শান্তি মিশনের বড় অংশীদার। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ এবং এলিট ফোর্সের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নির্যাতন গুম ও খুনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে ফ্রান্সের সতর্কতার মুখেও পড়তে হতে পারে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে রয়েছে। আর আফ্রিকায় সাম্রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার সময়ে ফ্রান্সের দরকার নতুন ব্যবসায়িক গন্তব্য। দু’দেশের জন্যই তাই এ সফর গুরুত্ব বহন করছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ কতখানি এগিয়ে যেতে পারে; সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়