ফার্নেস অয়েলের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অস্বস্তিতে সরকার !

ইসমাইল আলী: বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৯০৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৫০৩ মেগাওয়াট। উৎপাদন সক্ষমতা ২১ শতাংশ এ খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর। তবে ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানি করতে না পারা, ডলারের বিনিময় হার নিয়ে জটিলতায় এ খাতের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কখনও কখনও উৎপাদন নেমে যাচ্ছে একেবারে তলানিতে।

গতকাল সকাল ৭টায় ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় মাত্র ১৮১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে, যা এ খাতের সক্ষমতার মাত্র সোয়া তিন শতাংশ। এর আগে ভোর ৫টায় ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে ৩৬৪ মেগাওয়াট ও ৬টায় ১৮৭ মেগাওয়াট। বেলা ৩টা পর্যন্ত এ জ্বালানিভিত্তিক উৎপাদন ৩০০ মেগাওয়াটের ঘরেই ছিল। এরপর বাড়লেও রাত ৮টায় পিক আওয়ারে ৮৯১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আর সন্ধ্যা ৭টায় গতকাল দিনের সর্বোচ্চ এক হাজার ১২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয়, যা এ খাতের সক্ষমতার সোয়া ২০ শতাংশ। অর্থাৎ সর্বোচ্চ উৎপাদনের পরও ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার প্রায় ৮০ শতাংশ বসে ছিল। যদিও বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হচ্ছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ছে এখন অনেক বেশি। সে তুলনায় গ্যাস ও কয়লা অনেক সাশ্রয়ী। বর্তমানে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়ে দুই থেকে তিন টাকা। তবে গ্যাসের সংকটের কারণে বর্তমানে এ খাতের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১১ হাজার ৬৭৭ মেগাওয়াট। তবে উৎপাদন করা হয় পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের মতো।
এদিকে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়ে ছয় থেকে সাত টাকা। এ খাতের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা (আদানি বাদে) পাঁচ হাজার ৬০৩ মেগাওয়াট। তবে ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় এ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আড়াই থেকে চার হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়ে ১৬ থেকে ১৮ টাকা। উচ্চ ব্যয় ও জ্বালানি তেল আমদানি করতে না পারায় এসব কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গচ্চা দিতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলো অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। মূলত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এসব কেন্দ্রের অনুমোদন পায়। আবার চাহিদা না থাকলেও বেশকিছু কেন্দ্রের লাইসেন্স নবায়ন করে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় বিগত সরকার। এতে এখন বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের পেছনে অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও জ্বালানি ব্যয় পড়ছে অনেক বেশি। ফলে ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলোর এখন বোঝা হয়ে উঠেছে। এদিকে আওয়ামী লীগের সময়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরাসরি ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমোদন নেয়। আর এ তেল আমদানি ব্যয়ের ওপর ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করে। ফলে বিদ্যুতের পাশাপাশি তেল আমদানিও তাদের একটা লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তর হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় পিডিবি আপত্তি জানালেও তা কর্ণপাত করেনি হাসিনা সরকার। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকার চুক্তিতে নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ কমিয়ে পাঁচ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।

সূত্রমতে, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পিডিবি এক চিঠিতে ৪৮টি বেসরকারি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নতুন সার্ভিস চার্জ সম্পর্কে অবহিত করে। এটিকে বিদ্যুৎ খাতের ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ন্ত্রণের একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। যদিও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর থেকে বেসরকারি খাতে স্থাপিত ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য তেল আমদানির সুবিধা চালু করা হয়। সে সময় ১১টি ক্যাটেগরির মধ্যে সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা হয়। পিডিবি এ সার্ভিস চার্জ পর্যালোচনা করতে সদস্য (অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিশের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি চার্জ ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের সুপারিশ করে। কারণ তারা দেখতে পায়, পূর্ববর্তী চার্জের মধ্যে অনেক খাত এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়।

আগের নির্ধারিত খাতগুলোর মধ্যে রয়েছেÑভ্যাটসহ এলসি খোলার কমিশন (শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ), ভ্যাটসহ এলসি গ্রহণ কমিশন (এক দশমিক ১৫ শতাংশ), কনফার্মেশন চার্জ (এক দশমিক ৩৬ শতাংশ), ৭৫ দিনের মধ্যে পেমেন্ট করলে ছাড় চার্জ (শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ), শুল্কের সুদ (এক দশমিক ২৪ শতাংশ), স্টোরেজ ভাড়া (এক দশমিক ৪৩ শতাংশ), সমুদ্রপথে ক্ষতি (শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ), অভ্যন্তরীণ পরিবহনসহ হ্যান্ডলিং ক্ষতি (শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ), থ্রুপুট চার্জ (শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ), বিআইডব্লিউটিএ ল্যান্ডিং চার্জ (শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ), ডেমারেজ চার্জ (শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ) এবং ওভারহেড চার্জ (শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ)।
এদিকে ফার্নেস অয়েলের আমদানি মূল্য পরিশোধ নিয়েও জটিলতা রয়েছে। মূলত ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে এ জটিলতা শুরু হয়। জ্বালানি তেলের মূল্য ১২০ দিনের মধ্যে পরিশোধের শর্ত থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই পিডিবি তা পরিশোধে বিলম্ব করত। তবে অর্থনৈতিক সংকট শুরুর পর হাসিনা সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ছাড় কমিয়ে দেয়। এতে বিদ্যুতের বিল পরিশোধে বিলম্ব হতে শুরু করে। এর মধ্যে ডলারের বিনিময় হার অনেক বেড়ে যায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা) কয়েক দফা সরকারের কাছে আবেদন করেও বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনি। তাদের মতে, বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য এলসি খুলে তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৮ টাকা। তবে সরকার যখন এ বিল পরিশোধ করে ততদিনে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে ১০৮ টাকা হয়ে যায়। তবে পিডিবি ৯৮ টাকা দরেই বিল পরিশোধ করে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা বিল পরিশোধের সময়ের বিনিময় হার বিবেচনার জন্য অনুরোধ করে। তবে বিষয়টি আড়াই বছরেও সমাধান হয়নি। এর মধ্যে সার্ভিস চার্জ কমানোকে সরকারের ‘খামখেয়ালি’ বলে মনে করছেন বিপ্পা সভাপতি কেএম রেজাউল হাসানাত। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প খাত ও সেচ কার্যক্রমের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা না করেই কারও পরামর্শ ছাড়াই এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকার যদি সার্ভিস চার্জ নতুন হারেই নির্ধারিত রাখে তবে কেউ জ্বালানি তেল আমদানি করব না; বরং বিপিসি থেকে ভারী জ্বালানি তেল সংগ্রহ করবে।’

যদিও বিপিসিকে প্রয়োজনে তেল সরবরাহের জন্য প্রস্তুতি নিতে অনুরোধ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ বলেন, যদি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে, তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তেল সরবরাহ নিশ্চিত করবে।