ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি পশ্চিমাদের অবজ্ঞা স্মরণীয় হয়ে থাকবে

ওয়েন জোন্স: একজন ফিলিস্তিনির জীবনের মূল্য কত? গাজার ধ্বংসস্তূপে পুরো পরিবারের সঙ্গে এরই মধ্যে সমাহিত হননি যারা এবং মনে এখনও কিঞ্চিৎ আশা জিইয়ে রেখেছেন, এমন ফিলিস্তিনিদের জন্য জো বাইডেন গত সপ্তাহে একেবারে সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়েছেন। চলমান তাণ্ডব শুরু হওয়ার ১০০ দিন পূর্তিতে একটি বক্তব্যে তিনি হামাস দ্বারা অপহরণকৃত ইসরাইলি জিম্মি ও তাদের পরিবারের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। এটা ঠিকই করেছেন। হামাস গুরুতর যুদ্ধাপরাধ করেছে। কিন্তু তিনি একটিবারও ফিলিস্তিনিদের কষ্টের কথা উল্লেখ করেননি।

পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও মিডিয়াও একইভাবে ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি তাদের অবজ্ঞা লুকানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। আসলে এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। তবে প্রতিক্রিয়াগুলো এখন সহিংসতার সঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো ৭৬ বছর আগে আনুমানিক ১৫ হাজার সহিংস মৃত্যু ঘটানোর মাধ্যমে ১০ লাখ ফিলিস্তিনির তিন-চতুর্থাংশকে নির্লজ্জের মতো তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত না করলে আজকের তিক্ত ফসলের বীজ রোপণ করা হতো না। রাজনীতি ও মিডিয়ার ক্ষমাতাবানেরা এমন খেলা শুরু করেছিল, যা আজও চলছে। কতজন জানতে পেরেছেন যে, গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের দ্বারা সংঘটিত অবর্ণনীয় নৃশংসতার আগে, শুধু পশ্চিম তীরেই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ২৩৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে তিন ডজনেরও বেশি শিশু ছিল? অনেকে বলে, জীবন সস্তা। আর ফিলিস্তিনিদের জীবন দৃশ্যত অর্থহীন।

যদি ফিলিস্তিনিদের জীবনের ন্যূনতমও মূল্য থাকত, তাহলে গত কয়েক দশকের দখলদারিত্ব, অবরোধ, অবৈধ উপনিবেশ, বর্ণবাদ, সহিংস দমন ও গণহত্যা হয়তো কখনোই ঘটতে পারত না। মানুষ হিসেবে গ্রহণ করা হলে তাদের ওপর অত্যাচার করা কঠিন হওয়ার কথা।

যারা ফিলিস্তিনি জীবনের প্রতি পশ্চিমা উদাসীনতাকে সমর্থন করেন না, তারা আশা করেছিলেন যে, এই ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে, শেষ পর্যন্ত অবশ্যই এ অত্যাচারের অবসান হবে। নিঃসন্দেহে ১০ হাজার শিশুর সহিংস মৃত্যুর পর, অথবা প্রতিদিন গড়ে ১০টি শিশুর এক বা উভয় পা কেটে ফেলার পর (বেশিরভাগই চেতনানাশক ছাড়া) শক্তিশালী আবেগকে আলোড়িত করবে। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার ৫০০ গর্ভবতী মহিলা জন্ম দিচ্ছেন, যাদের অনেকেরই চেতনানাশক ছাড়াই সিজারিয়ান হয়েছে। হাইপোথার্মিয়া ও ডায়রিয়ায় নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে। এসব নিশ্চয়ই একটি অপ্রতিরোধ্য বিদ্রোহের কারণ হবে। ইসরায়েল গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে, যার কারণে এক বছরের মধ্যে গাজার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মারা যেতে পারে। এ সম্ভাবনা ইসরাইলের অত্যাচারের অবসান ঘটানোর জন্য অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে কিছু না কিছু করবে, এমনটাই আশা ছিল। তারা ভেবেছিলেন, ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে একাধিক আত্মীয়-স্বজন, এমনকি তাদের পুরো পরিবারসহ সহায়তা কর্মী, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের হত্যার অন্তহীন গল্প শেষে পশ্চিমা সমাজে অবশ্যই একটি অপ্রতিরোধ্য সেøাগানের ঢেউ উঠবেÑ‘বন্ধ করো এই তাণ্ডব, এই ঘৃণ্য পাগলামি এখনই বন্ধ করো।’ কিন্তু তেমনটি ঘটেনি। আর এর পরিণতি হবে গুরুতর।

ফিলিস্তিনিদের জীবনের অবমূল্যায়ন কোনো অনুমান নয়। এটি একটি পরিসংখ্যানগত সত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সংবাদপত্রের কভারেজের একটি নতুন গবেষণা অনুসারে, প্রতিটি ইসরায়েলির মৃত্যুর জন্য ইসরায়েলিদের উল্লেখ করা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের প্রতিটি মৃত্যুর তুলনায় আট থেকে ১৬ গুণ বেশি বার। ডেটা বিশেষজ্ঞ ডানা নাজ্জার ও জ্যান লিয়েতাভা বিবিসি কভারেজের একটি বিশ্লেষণে একই রকম বিধ্বংসী বৈষম্য পাওয়া গেছে। ‘মা’ বা ‘স্বামী’র মতো মানবিক শব্দগুলো ফিলিস্তিনিদের বর্ণনা করার জন্য অনেক কম ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ‘গণহত্যা’ বা ‘খুন’-এর মতো আবেগপ্রবণ শব্দ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে হামাসের নৃশংসতার শিকার ইসরায়েলিদের জন্য।

এ সবেরই একটি গভীর প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, ভবিষ্যতে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের প্রত্যাশাগুলো ভুলে যেতে হবে। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ এরই মধ্যে এ ধরনের বকধার্মিকতাকে অবজ্ঞার সঙ্গে বিবেচনা করেছে। তারা এ কর্মকাণ্ডকে পশ্চিমের আরেকটি ধাপ্পাবাজি হিসেবেই দেখছে, বিশ্বের আর সব দেশগুলোকে ছিঁবড়ে ধনী হয়ে ওঠা দেশগুলোর কৌশলগত স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার ধাপ্পা। ঠিক যেমনটি বহু শতাব্দী ধরে গণহত্যামূলক উপনিবেশের ফলে দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। অথবা যেমনটি সাম্প্রতিক রক্তক্ষয়ী ইরাক যুদ্ধ বা একাধিক মহাদেশ জুড়ে নীরব অত্যাচারের জন্য সক্রিয় সমর্থন দিয়ে চলেছে। বোমা, বুলেট, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও চিকিৎসা সুবিধা ধ্বংসের মাধ্যমে পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র ও সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েল গাজার ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দেয়ার পরে বদ্ধ পগল ছাড়া আর কেউ ভবিষ্যতে পশ্চিমের কোনো ধরনের মানবতাবাদী দাবি আর শুনবে না।

তবে অন্যান্য দেশই পশ্চিমা রাজনৈতিক ও মিডিয়া নেতাদের জন্য আতঙ্কিত হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। তারা নিজের দেশেও নৈতিক পতনের কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো দেশের তরুণ প্রজন্মরা বর্ণবাদকে তাদের আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়ার শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। জনমত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তরুণরা বয়স্ক নাগরিকদের তুলনায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। তারা সোশ্যাল মিডিয়ার উৎসাহী ব্যবহারকারী। সেখানে তারা গাজায় আক্ষরিক অর্থেই একর পর এক নৃশংসতার ফুটেজ দেখছে। তারা দেখেছে কীভাবে ইসরায়েলি সৈন্যরা ফুর্তি করতে করতে বিনোদনের খোরাক হিসেবে যুদ্ধাপরাধমূলক কাজ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছে।

আইরিশ আইনজীবী ব্লিয়েন নি গ্রালাই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলা করার সময় এটিকে ইতিহাসের প্রথম গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে এর শিকাররা মরিয়া হয়ে ইন্টারনেটে লাইভে তাদের নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া সম্প্রচার করছে। কারণ তারা এখনও আশা করে আছে, বিশ্ব হয়তো তাদের জন্য কিছু করবে। এটা এখন পর্যন্ত নিরর্থক আশা। নবজাতকের প্রাণহীন মৃতদেহ আঁকড়ে চিৎকার করা অসংখ্য মায়েদের ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করা হয়েছে। তরুণ প্রজšে§র জন্য এসব ভিডিও তাদের যা শেখানোর শিখিয়েছে।

এখন এ তরুণ প্রজন্ম এরকম অথর্ব মিডিয়া কাভারেজ, বা রাজনীতিবিদদের এসব বিবৃতি নিয়ে কী করবে, যা ফিলিস্তিনিদের জীবনকে মোটেই মূল্যবান বলে মনে হয় না? যাদের মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতারা ফিলিস্তিনি জীবনের প্রতি তাদের অবজ্ঞাকে লুকানোর চেষ্টা পর্যন্ত করছে না, সেই পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমাগত কমতে থাকা জনসংখ্যা সম্পর্কে কী ধারণা প্রমাণিত হচ্ছে?

তাই, হ্যাঁ, আমরা দেখেছি কীভাবে ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে মানতে অস্বীকার করাটা আজকের দুঃস্বপ্নকে অনিবার্য করে তুলেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, কীভাবে পশ্চিমা বৈশ্বিক আধিপত্যকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য ব্যবহƒত নৈতিক দাবিগুলো চিরতরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু পশ্চিমা রাজনৈতিক ও মিডিয়া নেতারা বুঝতে পারছেন না  ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা হাজার হাজার অজ্ঞাত ফিলিস্তিনি মৃতদেহের পাশাপাশি তাদের নৈতিক কর্তৃত্বও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এটা এমন একটি টার্নিং পয়েন্ট যে যখন এর পরিণতি প্রকাশ পাবে, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।

লেখক ও কলামিস্ট