ফিলিস্তিনে আর্তনাদ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতা


আবদুর রাব্বি হাসান: একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যখন বিশ্ব উপভোগ করছে প্রযুক্তির উৎকর্ষ, তখনই এক কোণেÑফিলিস্তিন নামের ভূমিতে চলছে এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়। হাজার হাজার নারী-শিশুর আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানবতা আর সীমানাহীন অবরোধ পৃথিবীব্যাপী ফিলিস্তিনের নিত্যদিনের লোমহর্ষক সংবাদ। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাজনৈতিক বিরোধ নয় বরং এটি ইতিহাস, মানবতা, ধর্ম, রাজনীতি ও অধিকারÑসবকিছুর এক জটিল মিশ্রণ।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার অংশ। এটি মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের জন্য পবিত্র স্থান হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের বেলফোর ঘোষণা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পথ উš§ুক্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় এবং সেই সময়েই ঘটে অর্থাৎ বিপর্যয়। প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করা হয়। সেই থেকে শুরু হয় এক অব্যাহত সংঘাত, প্রতিরোধ ও দখলের ইতিহাস।
আজকের গাজা এক খোলা কারাগার। প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস করে মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার জায়গায়; যেখানে প্রতিনিয়ত নজরদারি করে ড্রোন, বিস্ফোরণ ছড়ায় বোমা আর সঙ্গী হয় ক্ষুধা ও মৃত্যুর ভয়। পানি, খাবার, ওষুধসহ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুরই ঘাটতি এখানে স্বাভাবিক। প্রতি কয়েক বছর পরপর চালানো হয় বড় আকারের হামলা, যাতে প্রাণ হারায় হাজার হাজার নিরীহ নারী ও শিশু। বিশেষ করে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনে ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার শিশু। নারী, পুরুষ, শিশুÑকেউই রেহাই পাচ্ছে না এই নির্বিচার হামলা থেকে। বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এমনকি মসজিদসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ও ধ্বংসের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে শুধু গাজা নয়, পশ্চিম তীরেও চলছে দখলদার ইসরায়েলের বসতি স্থাপন, অভিযান ও নির্বিচার গ্রেপ্তার। ফিলিস্তিনি জনগণ যেন এক দুঃস্বপ্নে আটকে আছে, যেখান থেকে তারা মুক্তি চায়।
ইসরায়েল দাবি করে, তারা আত্মরক্ষার জন্য এসব অভিযান চালাচ্ছে। হামাসের রকেট হামলা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে তারা প্রচার করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া হয় অতিমাত্রায় সহিংস ও অনিয়ন্ত্রিত; যা স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা মনে করে। তাদের মতে, তারা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে। তাদের ভূমি, ঘর, ইতিহাসÑসবকিছু কেড়ে নেয়া হচ্ছে; প্রতিক্রিয়া না জানালে তারা কীভাবে টিকে থাকবে?
বিশ্ব রাজনীতি এই সংকটে গভীরভাবে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক; সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এ ইস্যুতে মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বও চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়া প্রায়ই ইসরায়েলের ভাষ্যকে প্রাধান্য দেয়, ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ চাপা পড়ে যায়। জাতিসংঘ অসংখ্য প্রস্তাব পাশ করলেও তার বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। ইউরোপ দ্বিধাবিভক্ত আর মুসলিম বিশ্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নীরব দর্শক। কিছু দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে কণ্ঠ তুললেও তা বাস্তব পরিস্থিতি বদলাতে যথেষ্ট নয়। গোটা বিশ্ব যখন ভয়াবহ অমানবিকতা প্রত্যক্ষ করছে তখন মানবতার বুলি আউড়ানো বিশ্বনেতারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।

বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান করে আসছে। যেসকল দেশ সরাসরি অবস্থান নিতে পারছে না, অন্তত পরোক্ষভাবে হলেও তাদের স্পষ্ট অবস্থান নেয়া উচিত। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকে আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েলকে চাপে ফেলার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বয়কট হতে পারে একটি কার্যকর প্রতিবাদী হাতিয়ার।
ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস আর বর্তমান করুণ বাস্তবতা শুধু একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়; এটি আমাদের বিবেক, মূল্যবোধ ও মানবতার চরম পরীক্ষা। প্রতিদিন আমরা দেখছি নিষ্পাপ শিশুদের মৃতদেহ, মায়ের আহাজারি, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া স্বপ্নÑএসব দৃশ্য কেবল চোখে অশ্রু এনে দেয় না, আত্মাকেও কাঁদিয়ে তোলে। এই রক্ত, এই কান্না, এই নিঃস্বতা আমাদের সবাইকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়Ñমানবতা আজ কোথায়?
জেরুজালেম যেটি মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি তিনটি ধর্মের জন্যই পবিত্রÑআজ পরিণত হয়েছে সংঘাতের কেন্দ্রস্থলে। অথচ ধর্ম তো মানুষকে শেখায় শান্তি, সহনশীলতা আর ভালোবাসা। তাহলে ধর্মের নামে এই অমানবিকতা কেন? মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, ‘যে কেউ একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সুরা আল-মাজ়িদহ: ৩২)
ফিলিস্তিনের মুসলিমরা শুধু একটি ভূখণ্ড নয় বরং তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে। তারা নামাজ পড়ে বোমার শব্দে, রোজা রাখে খাদ্যের অভাবে ও সন্তানদের কোরআন শেখায় ধ্বংসস্তূপের মাঝে। তাদের এই আস্থা, সাহস ও সংগ্রাম এক অদম্য আত্মিক শক্তির প্রমাণ। আমাদের হƒদয়ে যদি সামান্যতম মানবতা থাকে তাহলে আজই আমাদের দাঁড়াতে হবে তাদের পাশেÑযুদ্ধে না হোক, অন্তত কণ্ঠে ও হƒদয়ে।
বিশ্ব যদি আজ নীরব থাকে, তাহলে আগামীকাল ফিলিস্তিনের কান্না শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, মানবতার ব্যর্থতার চিহ্ন হিসেবেই চিরদিনের জন্য রয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজš§ তখন প্রশ্ন করবেÑতাদের জন্য আমরা কী করেছিলাম? ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো মানে কেবল একটি জাতির পাশে দাঁড়ানো নয়Ñএটি মানবতার, ন্যায়ের ও বিবেকের পক্ষেই অবস্থান নেয়া। যতদিন ফিলিস্তিন পরাধীন, ততদিন এই বিশ্বে শান্তির দাবি কেবলই একটি হাস্যকর প্রহসন। তাই আসুন, তাদের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করি, তাদের সংগ্রামকে সম্মান করি এবং দখলদার ইসরায়েলের গণহত্যাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরি।

আব্দুর রাব্বি হাসান ওয়ালিদ

শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়