ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস?

ইমরান লস্কর: বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধের থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো কোনো দেশের সীমান্তে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় রয়েছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সৌদি-ইয়ামেন যুদ্ধ, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ, চীন-ভারত যুদ্ধ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চলমান। আমেরিকা-আফগানিস্তান যুদ্ধে টানা ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে আমেরিকা ২০২১ সালে সৈন্য গুটিয়ে নিয়েছে। এসব যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে তুঙ্গে থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো এখন বেশ সরগরম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ চলমান। গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র ও স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস গাজা উপত্যকা থেকে প্রথমবারের মতো ইসরাইলে আক্রমণ করে। মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রকেট নিক্ষেপ করে। ইসরাইলও গাজায় পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে চলমান টানা এক সপ্তাহের এই যুদ্ধে হামাসের হামলায় ইসরাইলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৯০০ মানুষ। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৩৮৮ জন। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, ইসরাইলি হামলায় গাজায় নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ফিলিস্তিনি। প্রশ্ন এখানেই, জাতিসংঘের মতো পৃথিবীতে সংঘ থাকতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত এত যুদ্ধক্ষেত্রের আবির্ভাব হয় কীভাবে? যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বাস্তবায়নে কতটা সফল পৃথিবীর বিবেকখ্যাত এ সংঘটি?

পৃথিবীতে এসব যুদ্ধ আসলে হঠাৎ করেই সংঘঠিত হয়নি। আজ যে বড় বড় ঘটনা ঘটছে, সে ঘটনা অতীতের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রতিফলন মাত্র। অতীতের ঘটনাগুলোই বর্তমানে বড়সড় হয়ে প্রতিফলিত হয়। লেখক ও অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান তার ‘বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর’ গ্রন্থে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেপথ্যে বলেছেন, ঊনবিংশ শতকের সংঘটিত ঘটনারই প্রতিফলন বিংশ শতাব্দীতে ফল হিসেবে পৃথিবী পেয়েছিল ‘প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতে, ছোট ছোট বালুকণা/বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তোলে মহাদেশ/সাগর অতল। শুরুতেই যে যুদ্ধগুলোর নাম উল্লেখ করেছি সেই প্রত্যেকটা যুদ্ধ কবির পঙ্ক্তির ভাষায়, ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল। তাহলে কি আমরা বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে সাগর, মহাসাগরের মতো তৃতীয় কোনো বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি? কেননা, আজ যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধগুলো পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করছে, কয়েক দশক পরে এই যুদ্ধগুলোই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিয়ামক হবে না তা বেশ সন্দেহাতীত। চলমান ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে একটু জেনে আসি। তাহলে বিষয়টি বুঝতে বেশ সুবিধা হবে।

সপ্তম শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ ১২০০ বছর ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ফিলিস্তিন তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবলয়ের বিরুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজয় বরণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবলয় জয়লাভের নেপথ্যে ছিল কৃত্রিম ফসফরাস বোম। ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বেইজম্যান সেই দুর্লভ বোমার আবিষ্কারক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটিশবলয় ড. হেইস বেইজম্যানকে তাৎক্ষণিক উপহার দিতে চাইলে ড. বেইজম্যান উপহারস্বরূপ ফিলিস্তিনের বুকে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের দাবি করে। বেইজম্যানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য ১৯১৮-১৯৪৮ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর ফিলিস্তিনকে উপনিবেশ হিসেবে ব্রিটিশরা শাসন করতে থাকে। তখন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনি জনগণকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার মিথ্যে আশ্বাস দেয়। মূলত ৩০ বছরে এই মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁকে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জাহাজভর্তি করে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আশ্রয় দিতে থাকে। ১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনে মাত্র ৩.২ শতাংশ ইহুদির বাস করত। ১৯১৮ সালে ফিলিস্তিনে যেখানে ইহুদি ছিল মাত্র ২০ হাজার সেখানে মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে ১৯৪৮ সালে ইহুদি জনসংখ্যা উন্নীত হয় ৬ লাখে! ১৯৪৮ সালে ১৪ মে রাতের আঁধারে ইসরাইল নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশ হাত গুটিয়ে নেয়।

পরবর্তীতে ইঙ্গো-মার্কিনের সহায়তায় ইঙ্গো-মার্কিন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘে এই বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে দুখণ্ড ঘোষণা করার দাবি রাখে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, পেরু প্রভৃতি রাষ্ট্র। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করে ভারত, পাকিস্তান, ইরান। তবুও স্বাধীন ফিলিস্তিনকে ভেঙে ৫৭ শতাংশ ভূমি নিয়ে ইসরাইল আর ৪৩ শতাংশ ভূমি দেয় ফিলিস্তিনকে। অথচ ইহুদি জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ। জাতিসংঘ সেদিন একপাক্ষিক ও একচোখা সিদ্ধান্ত নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সুপার পাওয়ার তথা পরাশক্তি হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে দুটি রাষ্ট্রের। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি রাশিয়া। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে বলা হয় ‘স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ’। ফলে গোটা পৃথিবীটা দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। এজন্য আমরা দেখতে পাই, রাশিয়া ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয়, অন্যদিকে আমেরিকা ইসরাইলকে সমর্থন দেয়। একটা কথা খুব জোরেসোরে মনে রাখা দরকার, রাশিয়া-আমেরিকা কোনো স্বার্থ বা লাভ ছাড়া কোনো দেশ বা যুদ্ধকে সমর্থনকে করে না এবং তাদের সমর্থনই সমস্যার ক্ষত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তাদের সমর্থন অনেকটা কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো। যে রাশিয়া ইসরাইলের পক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থন করেছিল সে রাশিয়া পরবর্তী সময় মজলুম ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার পেছনে স্বার্থ ও রহস্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূল কারণ হলো আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের দিকে তাক করা। (বলা রাখা বাহুল্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় ইউক্রেন বর্তমান রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউক্রেন হলো পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্র। আমেরিকা-ব্রিটিন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ন্যাটো জোট চায় পূর্ব ইউরোপে তাদের আধিপত্য ও শক্তির বলয় বিস্তার করতে। তাই ২০০৮ সাল থেকেই ইউক্রেনকে ন্যাটোর জোটে যোগ করার আশ্বাস দিয়ে আসছে। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনেস্কি ন্যাটোতে যোগ দিতে তোড়জোড় চালাচ্ছে। যদি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয় তাহলে রাশিয়ার শক্তি অনেকটা কমে আসবে। এজন্যই মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এদিকে আবার চীন ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখলেও ভারত আবার ইসরাইলের দিকে ইতিবাচক। অথচ চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষকে ‘চরিত্রশোধনাগার’ নাম দিয়ে নির্মমভাবে দিনের পর দিন অত্যাচার করছে। আসলে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে সমর্থন দেয় না। এভাবে যদি পরাশক্তিগুলো দুইটি শিবিরে ভাগ হয়ে একটা সমস্যাকে দুইটি ভাগে ভাগ করে ফেলে তাহলে সে সমস্যা আজীবনেও সমাধান হবে না। সমস্যা লেগেই থাকবে।

বর্তমান পৃথিবীতে চলমান এই ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্রগুলোই আগামীর পৃথিবীতে ভয়াবহ এক সমস্যা সৃষ্টি করবে, যার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে আরেকটা নরকীয় হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এক্ষুণি থামানো দরকার। ফিলিস্তিন-ইসরাইলকে শুধু সমর্থন নয়, তাদের নিজ নিজ অধিকার বুঝিয়ে দেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, ইসরাইল পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। ইসরাইলকে এখন সম্পূর্ণ উৎখাত করে সমস্যা সমাধান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুরুতে ৪৩ শতাংশ ভূমি দিয়ে ফিলিস্তিনকে যে ভূমিখণ্ড দেয়া হয়েছিল সে ফিলিস্তিনকে ৪৩ শতাংশ ভূমিতেই স্বাধীন ফিলিস্তিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। তাদের আরও ভাবা উচিত, সমাজ এক অখণ্ড জিনিস। অনেকগুলো উপাদান নিয়ে সমাজ গঠিত হয়। পৃথিবীর এক কোণের কোনো সমাজে বিপ্লব হলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এসে ধাক্কা সে যুদ্ধের হাওয়া লাগে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। পুরো পৃথিবীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে। জাতিসংঘের এখনই উচিত স্বাধীন ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়া। এই ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে আরও শক্ত হস্তে দমন করতে হবে, অনেকটা কঠোর হতে হবে। পৃথিবীর মানুষ রাশিয়া-আমেরিকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, রাজনৈতিক স্বার্থে রক্তারক্তি খেলা আর পুনরায় দেখতে চায় না। এই রক্তারক্তি খেলা বন্ধ হোক। নির্বিচারে মানুষ  হত্যা বন্ধ হোক।

শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়