Print Date & Time : 8 September 2025 Monday 9:32 am

ফের এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াল খেলাপি ঋণ

জয়নাল আবেদিন: ঋণ পরিশোধে শিথিলতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে খেলাপি। এতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ফের এক লাখ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করেছে। ডিসেম্বর শেষে শিথিলতা পুরোপুরি উঠে গেলে খেলাপির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি ৩০ লাখ টাকা, জুন শেষে যা ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। সুতরাং তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। আর গত ৯ মাসে বেড়েছে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।

সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ০৭ শতাংশে, বেসরকারি খাতের ব্যাংকের পাঁচ দশমিক ৪৭ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকগুলোয় চার দশমিক ১২ শতাংশ ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের মোট ৬০টি ব্যাংকের ঋণ পরিসংখ্যান নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর সেপ্টেম্বর শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর খেলাপি অর্থাৎ শ্রেণিকৃত করা হয়েছে এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ খাত ও অফশোর ইউনিটে খেলাপির সমন্বিত পরিমাণ এটি।

জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সেপ্টেম্বর শেষে দুই লাখ ১৯ হাজার ২৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৪৪ হাজার ১৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ২৮ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। খেলাপির হার পাঁচ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

এদিকে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৩৪১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। খেলাপির পরিমাণ তিন হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। খেলাপির হার ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ২৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। খেলাপির হার চার দশমিক ১২ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ২৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ওই সময়ে খেলাপির হার ছিল আট দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর শেষে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।

খেলাপি হলে কোনো শাস্তি নেই বরং পুরস্কৃত হয়, যার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপিরা বারবার ঋণ পরিশোধের সময় পান, পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়। মামলা করে ঝুলিয়ে রাখে। বেশি সমস্যা হলে হাইকোর্টে গিয়ে রিট করে। এভাবেই বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব দীর্ঘসূত্রতার কারণে খেলাপি আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যার যার কারণে মন্দঋণ বাড়ছে। তাই মামলার দীর্ঘসূত্রতার কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় একসঙ্গে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যাগুলো সমাধানের পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি যেসব ব্যাংকের ঋণখেলাপি বেশি, তাদের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপ সৃষ্টি করতে পরামর্শ দেন তিনি।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত বছর কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না করার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছর আগের মতো ঢালাও শিথিলতা না দিয়ে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ছাড় দেয়া হচ্ছে। এ বছরের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ঋণগ্রহীতা তার চলতি বছরের ঋণের কিস্তির ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেই ওই ঋণকে খেলাপি করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তির ২৫ শতাংশ জমা দেয়ার পর কিস্তির বাকি ৭৫ শতাংশ পরবর্তী এক বছরের মধ্যে জমা দিতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ করতে হবে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, সাধারণভাবে প্রতি বছরের জুন ও ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেশি আদায় হওয়ায় খেলাপি ঋণ কমে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আদায় না করেই নানা ছাড় নিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত বছরের মতো ঢালাও সুবিধা না থাকায় চলতি বছরে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। শিথিলতা পুরোপুরি তুলে দিলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে। কেননা, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ছাড়ের আগেও নানা সুযোগ ছিল।

২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। ওই বছর ব্যাংকগুলোয় ৫২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়। যে কারণে ২০১৯ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ব্যাপক কমে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায় নেমে আসে। এর মাত্র তিন মাস আগে ওই বছরের সেপ্টেম্বর শেষে যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এসব কারণে ভালো ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উপায়ে গ্রাহকদের বুঝিয়ে যথাসময়ে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছে।