জি. কে. সাদিক: একটা সমাজের প্রচলিত পরিস্থিতির পরিবর্তন দু’ভাবে হতে পারে। প্রথমত, বাইরের আগ্রাসী শক্তির আক্রমণের কারণে পরিবর্তন হতে পারে। এটা হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া পরিবর্তন। যেটা শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো করে থাকে। দ্বিতীয়ত, পরিবর্তনের দাবিটা সমাজের বা দেশের ভেতর থেকেই দানা বেঁধে ওঠে; যা একসময় অহিংস বা সহিংস আকারে স্ফুরিত হয়। এমনই এক পরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ‘ব্যবস্থা পরিবর্তনের’ এই দাবি দেশটির জনসাধারণের। এই আন্দোলনের শুরু গত ২৫ মে মিনেসোটায় জাল নোট দোকানে ব্যবহারের মতো তুচ্ছ অভিযোগে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের নির্যাতনে আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড (৪৬) হত্যাকে কেন্দ্র করে। ফ্লয়েড হত্যার ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয় প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদের সে াগান হয় মৃত্যুর আগে ফ্লয়েডের করুণ আর্তি ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। প্রথমে শান্তিপূর্ণ থাকলেও পুলিশের মারমুখী আচরণের ফলে আন্দোলনে চরম সহিংস হয়ে ওঠে। চিরাচরিত ভঙ্গিতে ন্যায্য আন্দোলনে পুলিশের দমন শুরু হয়। ফলে আন্দোলন গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলকারীদের অন্যতম দাবিতে পরিণত হয় ‘ব্যবস্থা বদলানোর’ সেøাগান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘বহু বছর ধরে এ পরিস্থিতি চলছে। কোনো কিছুই বদলায়নি। সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে কিছু হবে না। সাধারণ মানুষের জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা পরিবর্তন চাই। এভাবে আর চলতে পারে না। আমরাও মানুষ, আমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে।’ মার্কিন গণমাধ্যম ‘দ্য হিল’-এ বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকে এমন কথাই বলছেন।
ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান আন্দোলন কেবল একটি হত্যার প্রতিবাদ বা দেশটিতে বিরাজমান বর্ণবাদী আচরণবিরোধী আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন গোটা সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ‘ব্যবস্থা পরিবর্তনের’ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। যে ব্যবস্থার ফলে দেশটিতে বর্ণবাদ, জাতি-বিদ্বেষ ও আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য টিকে আছে সে ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে মনে করছেন আন্দোলকারীরা। চলমান এই আন্দোলনকে ইতোমধ্যে ‘আমেরিকার বসন্ত’ নামেও অবহিত করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা এই আন্দোলনকে মার্কিন সমাজে দীর্ঘদিনে বর্ণবাদ, জাতি-বিদ্বেষ ও বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধের আন্দোলন বলে মনে করছেন। ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে এই আন্দোলন যেমন কেবল একটি হত্যার প্রতিবাদ বা প্রচলিত বর্ণবাদের বিরোধী আন্দোলনের আটকে নেই, তেমনি এটা ‘কালোদের আন্দোলনেও’ সীমাবদ্ধ নেই। চলমান আন্দোলনে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আর্থিক মন্দার প্রভাবে বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গরাও। বিশেষ করে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) পরিস্থিতির কারণে যেসব মার্কিনি নানাভাবে বিপর্যস্ত, বেকার ও হতাশায় ভোগছেন তারাও এই আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া চলমান আন্দোলনে অংশ নিয়েছে সঙ্গী হয় বামপন্থি, অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট উগ্র ও সহিংস এ্যান্তিফাসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী। একইভাবে এই আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছেÑকানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও বিক্ষোভ হয়েছে।
মার্কিন সমাজে বর্ণবাদ, বৈষম্য ও জাতি-বিদ্বেষ কতটা ভয়াবহ সেটা ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট মানবাধিকার গ্রুপ ‘ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স’-এর বরাদ দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ৮ হাজার মার্কিনকে হত্যা করেছে পুলিশ। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য মতে, কেবল ২০১৯ সালেই আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে ১০১৪ জন মারা গেছে। গবেষণায় বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পুলিশি হত্যাকাণ্ডে ৯৯ শতাংশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগই করা হয়নি। বিভিন্ন পাবলিক ডেটাবেজ এবং আইন প্রয়োগকারী রেকর্ড থেকে নেওয়া অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুলিশের হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশের হাতে প্রাণ হারানোর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালে হত্যার শিকার হয় ১১০৬, ২০১৪ সালে ১০৫০, ২০১৫ সালে ১১০৩, ২০১৬ সালে ১০৭১, ২০১৭ সালে ১০৯৫, ২০১৮ সালে ১১৪৩ এবং ২০১৯ সালে ১০৯৮ জন। কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার হার লাতিন আমেরিকানদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে তিনগুণ বেশি। সর্বোপরি পুলিশের হাতে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের নিরস্ত্র থাকার ঘটনা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। লাতিন আমেরিকানদের চেয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। জরিপের মতে, প্রতি সপ্তাহে ২৫ মার্কিনিকে হত্যা করেছে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা গেছে কৃষ্ণাঙ্গরা। নিহতের অধিকাংশই নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ। তাই চলমান আন্দোলনের অন্যতম আরেকটি সেøাগান হচ্ছে, ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’। ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ট্রেইভন মার্টিন নামে ১৭ বছর বয়সী এক কৃষ্ণাঙ্গকে ফ্লোরিডার স্যানফোর্ডে জর্জ জিমারম্যান নামে এক শ্বেতাঙ্গ গুলি করে হত্যা করে। পরে ২০১৩ সালে হত্যাকারী বিচারিক রায়ে ছাড়া পেয়ে যায়। কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার এমন বৈষম্যমূলক বিচারিক রায়ের পর ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’ নামে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীদের মুখেও এই সেøাগানটি বেশি শোনা যাচ্ছে। এই স্লোগানটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালের ৯ আগস্টে মিসৌরির ফার্গুসনে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসন কর্তৃক মাইকেল ব্রাউন নামে ১৮ বছর বয়সী এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে হত্যার পর ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’ আন্দোলনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাড়া ফেলে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে সহিংস বিক্ষোভে একজন মারা যায়, কয়েকশ আহত হয় এবং অসংখ্য আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হয়। ফ্লয়েড হত্যার মতোই পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার আরেক নৃশংস ঘটনা ঘটে নিউইয়র্কে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই মাসে। ওই সময়ও পুলিশ এরিক গার্নারকে খুচরা সিগারেট অবৈধভাবে বিক্রি করছে বলে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করার পর গলাটিপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। অন্তিম মুহূর্তে গার্নার বারবার কান্নাজড়িত গলায় আকুতি করেছিল, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। অন্তিম মুহূর্তে জর্জ ফ্লয়েড যেমন বলেছিল। চলমান বিক্ষোভে ফ্লয়েডের শেষ বাক্য ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ স্লোগানে পরিণত হয়েছে। এই স্লোগান গোটা মার্কিন মুলুকে বর্ণবাদ, জাতি-বিদ্বেষ, বৈষম্য ও দারিদ্র্যে কশাঘাত থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মূলমন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ঠিক এমন কথাই বলছেন বিশ্লেষকরা।
আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা ১৪ শতাংশ। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী মিলিয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ অশ্বেতাঙ্গ মানুষ রয়েছে দেশটিতে। এই বৃহৎ অশ্বেতাঙ্গ মানুষগুলো বরাবরই বর্ণবাদী আচরণ, জাতি-বিদ্বেষ ও নানা বৈষম্যের শিকার। জীবিকার ক্ষেত্রে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, পুলিশের আচরণে, বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়গুলোতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান ও হিস্পানিকরা বর্ণবাদী আচরণ ও বৈষম্যের শিকার। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই আন্দোলনকে দশকের পর দশক পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃত ও বৈধ হতাশার প্রকাশ বলে মনে করছেন। মিডিয়াম ডটকম নামে এক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো আমরা যদি আমেরিকার ইতিহাস দেখি তাহলে পাব, যখনই রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমাজকে প্রান্তিকীকরণের চেষ্টা করেছে তখনই বিক্ষোভ ও গণআন্দোলন শুরু হয়েছে। আমাদের এমন প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস, বিচারবিষয়ক দপ্তর ও কেন্দ্রীয় বিচারব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করতে হবে যারা সমাজের ঘুণপুকার মতো ক্ষয়কারী বর্ণবাদকে স্বীকার করে। তাই প্রকৃত পরিবর্তন চাইলে বিক্ষোভ ও রাজনীতির দুটোকেই সঙ্গে নিতে হবে।’ অন্যান্য বিশ্লেষকরাও মার্কিন মুলুকে চলমান বিক্ষোভকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের চূড়ান্ত স্ফুরণ বলে মনে করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক করনেল ওয়েস্ট বলেন, ‘পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা, সম্পদ ও সম্মান ভাগাভাগি করতে হলে অহিংস বিপ্লব বেছে নিতে হবে। না হয় এমন সহিংসতার আরও বিস্ফোরণ দেখতে হবে।’ সহিংসতা নিরসনে অধ্যাপক ওয়েস্ট বাস্তবভিত্তিক প্রতিষ্ঠানিক সাম্যের বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন। একই স্বরে কথা বলেছেন কিলি ইউনিভার্সিটির ক্রাউড বিহ্যাভিয়ার অ্যান্ড পাবলিক অর্ডার পোলিশিং বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্লিফর্ড স্টট। তিনি বলছেন, ‘ফ্লয়েড হত্যার মতো জঘন্য ঘটনাটি তৈরি করেছে পুলিশ। কারণ পুলিশ ও কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, সেটাই এখানে স্পষ্ট হয়েছে। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য আছে সেখানে এরকম সংঘাত অনেকটাই অবশ্যম্ভাবী।’
চলমান আন্দোলনের তোড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ইতোমধ্যে পুলিশ বাহিনীতে পরিবর্তন আনা শুরু হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া, মিনেপলিস, ডেনভার, উটাহসহ বিভিন্ন শহর ও রাজ্যে ইতোমধ্যে পুলিশের মধ্যে পরিবর্তন আনা বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তাই চলমান আন্দোলনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন হয়তো আসবে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বর্ণবাদ, জাতি-বিদ্বেষ, বেকারত্ব ও আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের যে মনস্ততত্ত্ব সেটা কি সহজে ভাঙবে?
ফ্রিল্যান্স লেখক, কুষ্টিয়া
ই-মেইল: sadikiu099@gmail.com