ফ্লাইওভারে নিচের জমি অপব্যবহারে বছরে ক্ষতি ২ বিলিয়ন ডলার

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর যানজট নিরসনে গত দুই দশকে উড়াল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি, ইউলুপ ও মেট্রোরেলসহ নানা রকম উড়ালপথ (ফ্লাইওভার) নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত মোট ১০৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এসব উড়ালপথের নিচে দখল-বেদখল, ব্যবহার-অব্যবহার ও অপব্যবহারে পড়ে আছে প্রায় ২০৭ একর জমি। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় এটি মূল্যবান নগর-সম্পদের অপচয়, যার নেতিবাচক প্রভাবে প্রতি বছর সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে; বাংলাদেশি মুদ্রায় যা অন্তত ২১ হাজার কোটি টাকা।

সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের (সিআইএইউ) গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। তবে সিআইএইউ বলছে, ঢাকার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে জনকল্যাণমুখী ও জনস্বাস্থ্যবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে উড়ালপথের নিচের এই মূল্যবান নগর-জমিকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব।

গতকাল রোববার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিআইএইউর সেমিনার রুমে এ-সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সিআইএইউর নির্বাহী পরিচালক স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এ সময় সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার মনজুর হাসান, ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক, সাংবাদিক এমএম মুসাসহ কয়েকজন পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক স্থপতি অধ্যাপক

আদনান জিল্লুর মোর্শেদ জানান, ফ্লাইওভার যেমন নগরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থাকে গতিশীল করছে, তেমনি এর নিচের জায়গাগুলোও গণপরিসর তৈরিতে ও জনকল্যাণমুখী কাজে ব্যবহার করার সুযোগ আছে।

তিনি বলেন, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচে বেশকিছু জায়গায় পার্কিং, পাবলিক টয়লেট, পুলিশ বক্স, মসজিদ, অস্থায়ী কাঁচাবাজার, ময়লা ফেলার ভাগাড় এবং ছোট দোকান গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও অন্ধকারে ছিন্নমূল মানুষের থাকার জায়গা চোখে পড়েছে। কিছু জায়গায় নি¤œবিত্ত ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন ও পথশিশুদের খেলাধুলার জন্য ব্যবহার করছে। অনেক সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাগুলোয় মাদক সেবন ও মাদক কেনাবেচা হয়। পথচারীদের জন্যও এটি নিরাপত্তার হুমকি। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে সবুজায়ন করেছে। মূল বিষয় হলো, সামগ্রিকভাবে এ নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই। ফলে বেশিরভাগ জমির সুষম ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি।

ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোয় বর্তমানে ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড  স্ট্রাকচারের নিচের অংশে জনবান্ধব, টেকসই ও সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার উপযোগী  কমিউনিটি জোন তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে রয়েছে হাঁটাচলার পথ ও সাইকেলের লেন, নগর-কৃষি, বাগান, বনায়ন ও  খেলাধুলার ব্যবস্থা। কিছু জায়গায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও শরীরচর্চা কেন্দ্র, সুইমিং পুল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পথনাটক ও শিল্পকর্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা নি¤œ আয়ের মানুষরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। উড়াল সড়কের মতো অবকাঠামোর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। এ বিষয়ে নগর প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং পরিকল্পনাগত ঘাটতি পূরণে অবদান রাখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’

সিআইএইউ জানিয়েছে, এ গবেষণা প্রকল্পের পদ্ধতি হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন ফ্লাইওভার-সংলগ্ন এলাকার স্থানীয়দের মাঝে নৃতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়েছে, যেখানে ব্যবসায়ী, অস্থায়ী দোকানদার, বাসাবাড়িতে বসবাসকারী মানুষ, পথচারী এবং সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। জরিপের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাদের প্রতিদিনকার জীবনে ফ্লাইওভার ও এর নিচে ঢাকা পড়া জায়গার প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এর পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ, পরিবহন বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তা ও আইনবিদদের সহায়তায় সার্বিক নীতিমালায় পরিবর্তন আনার ব্যাপারে নতুন কিছু ধারণা পাওয়া গেছে।

উড়াল সড়কের নিচের অব্যবহƒত জমির কার্যকর রূপান্তরের এই গবেষণায় ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদের নেতৃত্বে কাজ করেছেন স্থপতি শাফায়েত মাহমুদ, ওয়াসিলা ফাতিমা নিলিয়া এবং মো. ফাহিম হাসান রিজভী। এ ছাড়া বিভিন্ন ধাপে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী খান, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক, অর্থনীতিবিদ ড. সৈয়দ আখতার মাহমুদ, নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. ওয়ালিউর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজিনুল হক মোল্লা এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক তানভীর সোবহান।