রোহান রাজিব: স্বামী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বইমেলা ঘুরতে যান পপি পোদ্দার (৩০)। এরপর খেতে আসেন বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে। কিন্তু খাওয়া শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেননি। বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুনে মারা গেছেন চার জনই।
মধ্যরাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সামনে আহাজারি করছিলেন পপি পোদ্দারের পরিবারের সবাই। মেয়ে, মেয়ের জামাই এবং দুই নাতি-নাতনি হারিয়ে বাকরুদ্ধ নানি।
পপি পোদ্দারের মা বাসনা মর্গের সামনে বিলাপ দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘পপি কোথায় গেলি। কোথায় গেলি ও আদৃতা, ও সংকল্প। আমার জামাই কোথায় গেলো। এভাবে আমাকে একা করে কিভাবে গেলি তোরা। এ কী হয়ে গেল আমাদের? আগুনে একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল?’।
পপি পোদ্দারের ভাই পীযুষ শেয়ার বিজকে জানান, সবাই মিলে বইমেলা ঘুরতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে কাচ্চি ভাইতে খাইতে গেছে। খাওয়ার এক পর্যায় রেস্তোরাঁয় আগুন লেগে যায়৷ এতে বোন, বোনের জামাই এবং ভাগ্নে-ভাগ্নীরা আটকে পড়ে। ভাগ্নী ফোন দিয়ে বলে মামা আমাদের বাঁচাও। আগুনে আমরা আটকা পড়েছি। বের হতে পারছি না। এরপরই ফোন কেটে যায় আর কথা হয়নি। তারপর বেইলি রোড এসে কাউকে পাই না।
এরপর মধ্যরাতে ছুটে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। সেখানে সবার লাশ পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, ভাগ্নি আদৃতা (পড়ত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণিতে)। আর সংকল্প পড়ত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজের প্রথম শ্রেণিতে। বাবা–মায়ের সঙ্গে শান্তিবাগে থাকত তাঁরা।
অন্যদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে স্ত্রী ও দুই সন্তাকে হারিয়ে আর্তনাদ করছিলেন আশিক। আশিকের স্ত্রী নাজিয়ার কাছে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। বিষয়টি মা নাজিয়া স্বামী আশিককে ফোন করে জানিয়েছিলেন। আশিক ছিলেন অফিসে, বনানীতে। স্ত্রীকে বলেন, ছেলেদের নিয়ে পাশেই কোনও একটি রেস্টুরেন্ট যেতে। নাজিয়া দুই ছেলেকে নিয়ে যান খানাস নামে একটি রেস্টুরেন্টে। সেখানে গিয়ে বার্গার খেয়েছেন সবাই। কিন্তু খাওয়া শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেননি। বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুনে মারা গেছেন তিন জনই।
নাজিয়ার এক স্বজন রিফাত জানান, আশিক-নাজিয়ারা বেইলি রোডের বেইলি রিচ অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। আশিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠাও বেইলি রোড এলাকায়। বাসার পাশেই রেস্টুরেন্টে দুই ছেলেকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই খাওয়া যে শেষ খাওয়া হবে, ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেননি।
এইদিকে আগুনে কেড়ে নিলো ইতালি প্রবাসী মোবারকের পরিবারের সবাইকে। মাসখানেক আগে ইতালি থেকে দেশে এসেছিলেন প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন। ইতালিতে ব্যবসা করতেন তিনি। স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। স্ত্রী ও সন্তানদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভিসাও হয়ে গিয়েছিল সবার। কিন্তু ইতালি আর যাওয়া হলো না তাদের! বেইলি রোডের আগুনে পুড়ে স্ত্রী-সন্তানসহ মারা গেছেন মোবারক!
মোবারকের চাচাতো ভাই ফয়সাল জানান, পরিবারের সবাইকে নিয়ে ডিনার করতে গিয়েছিলেন মোবারক। সঙ্গে ছিল স্ত্রী স্বপ্না, দুই মেয়ে সৈয়দা কাশফিয়া ও সৈয়দা নূর এবং একমাত্র ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ। আগুনে পুড়ে সবাই মারা গেছেন।
ফয়সাল বলেন, ‘পরিবারটি ইতালিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু তাদের আর যাওয়া হলো না। ঢাকার মধুবাগে থাকতেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেতে যাওয়াটাই কাল হলো তাদের। পরিবারের আর কেউ বেঁচে রইলো না।’
বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুনে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের দুই কর্মী মারা গেছেন। কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজার জিসান বলেন, ‘আমাদের ২৫ জন স্টাফ ডিউটিতে ছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন। একজন জিহাদ হোসেন (২২)। অন্যজন রকি (২০)। তারা কাচ্চি ভাইতে কাজ করতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আগুন লাগার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে বাইরে বের হয়েছিলাম। সে সময় রেস্টুরেন্টে ১০ থেকে ১৫ জন কাস্টমার ছিল। আগুনের সূত্রপাত হয় নিচতলার চুমুক নামে একটি চায়ের দোকান থেকে।’
বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে বেইলি রোডে ছয়তলা একটি ভবনে ভায়াবহ লাগে। ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৩টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করে এবং রাত ১১টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ১০ জন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৩ জন মারা গেছেন। এছাড়া, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।
এছাড়া আগুনে দগ্ধদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪ জন ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৮ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমি সংবাদ পেয়ে দ্রুত চলে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে দ্রুত আসতে বললেন। এখানে এসে যা দেখলাম তা ভয়াবহ অবস্থা। বার্ন ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছেন। অপরদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৩ জন মারা গেছে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘যারা এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন, তাদের বেশিরভাগের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা বেঁচে আছে তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। আহতরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন। বাইরে কেউ আছে কি না, এখনো তথ্য পাওয়া যায় নি।’




