বগুড়ায় তৈরি হচ্ছে সৌদি ও কাতারের ঐতিহ্যবাহী পোশাক বেস্ত

পারভীন লুনা, বগুড়া: সৌদি আরব ও কাতারের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘বেস্ত’ তৈরি করেই সংসারের সচ্ছলতা এসেছে বগুড়া শহরের শিকারপুর পূর্বপাড়ার অনেক নারী ও পুরুষের। বিদেশি কাপড়ে হাতের কাজের নকশায় বেস্ত তৈরি হচ্ছে। বগুড়া সদরের এরুলিয়া ইউনিয়নের শিকারপুর পূর্বপাড়ায় বেস্ত আল নূর নামে কারখানা গড়ে উঠেছে। এখানে এই এলাকার নারী-পুরুষ মিলে ৩০ শ্রমিক কাজ করছেন। তাদেরই একজন আপেল সেখ।

আপেল সেখ বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এখন অভাব নেই বললেই চলে। যে নারী ও পুরুষ একটু হাতের কাজ জানেন বা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তারাই এ পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।’ পূর্ণ একটি বেস্ত তৈরি হতে ছয় থেকে সাতটি ধাপ পার করতে হয়। তার মধ্যে একটি ধাপ ‘মাসকারে’ বিশেষভাবে দক্ষ তিনি। তবে এখানে কাজ করতে করতে আপেল অন্য কাজও শিখেছেন বলে জানান।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজা-বাদশাদের ঐহিত্যবাহী পোশাক এই ‘বেস্ত’। এ পোশাকের চাহিদা ইসলামি দেশগুলোয় বেশি। ১০ বছর আগে নিজ বাড়িতে বেস্ত আল নূর নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন নূর আলম নামের একজন প্রবাসী।

প্রায় ২০ বছর আগে শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে ছিলেন নূর আলম। সেখানে পোশাক তৈরি কারখানায় কাজ করতেন তিনি। পাতলা কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের সুতা দিয়ে নকশা করা তার কাজ ছিল। একপর্যায়ে বেস্ত তৈরিতে হাতের কাজের সবগুলোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। সৌদি আরবে থাকার কয়েক বছর পর নূর আলম কাতারে যান। সেখানেও নূর আলম এই বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। পরে সেখানকার কারখানার মালিককে বলেন, এমন একটি কারখানা তিনি বাংলাদেশে স্থাপন করতে চান। দেশে কম মূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে চান। তখন তার কাতারের তৎকালীন মালিক রাজি হলে দেশে এসে নূর আলমসহ ১০ শ্রমিক মিলে বেস্ত তৈরির কাজ শুরু করেন।

নূর আলম প্রায় সময়ই এখন কাতার কিংবা সৌদি আরবে থাকেন। কারণ কাতারে তার ‘বেস্ত’ বিক্রির শোরুম রয়েছে। আর সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকানে তিনি দেশে তৈরি ‘বেস্ত’ পাইকারি মূল্যে জোগান দেন। দেশে তার ব্যবসা দেখাশোনা করেন মানিক হোসেন।

মানিক জানান, ঈদের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসবে এ পোশাকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সৌদি আরব কিংবা কাতার থেকে এই পোশাক তৈরির সব কাঁচামাল আমদানি করা হয়। সুতা ও সুই থেকে শুরু করে কাপড় সবই আসে উন্নত মানের। বেস্ত তৈরিতে স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রলেপযুক্ত সুতা, জরি ও নরম পাতলা কাপড় ব্যবহার করা হয়। এ পণ্যগুলো সৌদি আরব, কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আমদানি করা হয়। এমনকি এশিয়ার দেশ জাপান থেকেও আনা হয় এসব পণ্য।

ঐতিহ্যবাহী এ পোশাক তৈরি করতে একজন শ্রমিকের অন্তত সাত দিন সময় লাগে। প্রথমে কাপড় কেটে নকশার কাজ শুরু করতে হয়। নকশার প্রথম ধাপকে বলা হয় হেলা। এরপর করা হয় তুক্ত স্ট্রিপ। ব্রুজ, মাকসার ও বরদাকের পর সিলালার মাধ্যমে শেষ হয় এর ধাপগুলো। ধাপগুলো শেষ হলেই পূর্ণতা পায় ‘বেস্ত’।

মানিক জানান, এ পোশাকের বাংলাদেশে চাহিদা নেই বললেই চলে। তৈরি সব পোশাকই যায় সৌদি আরবে কিংবা কাতারে। দামও খুব ভালো। সেখানে প্রতিটি ‘বেস্ত’ নকশাভেদে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আবার অনেকগুলো দুই লাখ টাকায়ও বিক্রি হয়। এ কারখানা থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দুই কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়। কারখানাটি থেকে প্রতি বছর গড়ে ২৪ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়।

নূর আলমের কারখানায় একেক শ্রমিক একেক কাজ করেন। কেউ হেলায় দক্ষ, কেউবা সিলালাতে। ব্রুজের কাজে গত সাত বছরে ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করেছেন পোশাকের কারিগর মামুন। তিনি বলেন, ‘আগে আমি দর্জির কাজ করতাম। কয়েক বছর আগে নূর আলম আমাকে কারখানায় ডেকে ঐতিহ্যবাহী এই পোশাকে নকশার কাজের কথা বলেন। তখন আমাদের কাজও কম ছিল। একপর্যায়ে এই কারখানায় কাজ করা শুরু করলাম।’

কারখানায় ব্রæজের কাজ করেন রুবি। তার বাবা কৃষিকাজ করেন, মা গৃহিণী। ভাইবোনের মধ্যে রুবি বড়। করোনায় কলেজ বন্ধ থাকার কারণে এখানে এসে হাতের কাজ শেখেন তিনি। তার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা আয় করেন। এখান থেকে আয়ের টাকা দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করেন তিনি।

রুবি বলেন, কাজের ধরনভেদে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পাওয়া যায়। রুবির মতো হাসিনা, রেখাসহ আরও অনেক নারী এ কারখানায় কাজ করে সাংসারের অভাব ঘুচিয়েছেন।

‘বেস্ত আল নূর’ নামের এ প্রতিষ্ঠান এখন বেশ বড় পরিসরে শুরু করেছেন মালিক নূর আলম। বাংলাদেশ ছাড়াও বর্তমানে কাতারের দোহাতে বেস্ত আল সালেহ নামের আরেক একটি কারখানা তৈরি করেছেন তিনি। বেস্ত আল নূর এন্টারপ্রাইজের কাতারের ব্যবসা দেখাশোনা করেন মো. রবিউল ইসলাম রনি। তিনি বলেন, বেস্ত তৈরির কাঁচামাল, স্বর্ণের সুতা ইত্যাদি কাতার থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ এই মানের সুতা বাংলাদেশে বা তার আশপাশে নেই। কিন্তু সুতা বা অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক রকমের ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। এগুলো সহজ করা গেলে আমাদের জন্য ভালো হতো। একই সঙ্গে আমাদের দেশের বেকার নারী-পুরুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজ শেখানো গেলে তারাই সম্পদে পরিণত হবে।”

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তারা ছোট পরিসরে উদ্যোক্তাদের ঋণেরও ব্যবস্থা করে। জানতে চাইলে বগুড়া বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ছোট পরিসরে ঋণ দেয়াসহ মাঝে মাঝে পাঁচ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তারা যদি চান অন্য কোনো সহযোগিতা লাগলে আমাদের পক্ষ থেকে তা করা হবে।