প্রতিনিধি, বগুড়া : বগুড়া শহর থেকে উত্তরে ১১ কিলোমিটার পথ। গ্রামের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথঘেঁষে গ্রামটির আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা। সে গ্রামটির নাম চাঁদমুহা। গ্রামের নাম চাঁদমুহা হলেও এটি পাপড় ও ঝুরিভাজা গ্রাম নামেই লোকজনের কাছে পরিচিত। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে বাড়ির উঠানে বাহারি রঙের পাপড় ও ঝুরি রোদে শুকাতে দিয়েছেন নারীরা। এই গ্রামের বেশিরভাগ নারী জড়িয়ে আছেন পাপড় ও ঝুরি তৈরির কাজে। এটাই তাদের পেশা। এই পাপড় ও ঝুরিই তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।
চাঁদমুহা মধ্যপাড়া ও সরলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার আলু, গমের আটা ও চালের গুঁড়া দিয়ে পাপড় ও বাহারি রঙের ঝুরি তৈরি করেন। এই গ্রামের রাশেদা বেগম নিজে পাপড় বানিয়ে বিক্রি করেন। কথা হলো রাসেদার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমরা বছরজুড়েই পাপড় ও ঝুরি বানিয়ে বিক্রি করি। তবে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায় বেড়ে যায় এর চাহিদা।’
কাঁচা পাপড় দেখতে অনেকটা শুকনো রুটির মতো, যা তেলে ভাজলে ফুলে মচমচে হয়। মূলত পাপড় তৈরি হয় চালের আটা ও ময়দা দিয়ে, যার সঙ্গে মেশানো হয় লবণ, সোডা, বেসন, রংসহ মসলাজাতীয় নানা উপকরণ। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই চলে এই পাপড় তৈরি।
এক বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল টিনের ছোট একটি ঘর। মাঝখানে বসানো চুলা। সেখানে বসে বাড়ির গৃহিণী আমেনা পাপড় তৈরির উপকরণ মেশাচ্ছেন। একসময় উপকরণ তৈরি হলো। তারপর হাঁড়ির ওপর পরিমাণমতো পানি নিয়ে তা ফোটানো হলো। ভাপ উঠলে তিনি হাঁড়ির ওপর একটি স্টিলের থালা বসিয়ে তাতে গোল চামচে ময়দার মিশ্রণ প্লেটে ঢেলে দিলেন। এরপর থালাটি ঘুরিয়ে মিশ্রণটুকু পাঁপড়ের আকারে গোল করে একটি গামলায় রাখলেন। এগুলো পরে রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পরই তৈরি হয় ভাজার উপযোগী পাপড়।
আমেনা বলেন, শুকনো পাপড় তারা শহরে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। প্রতি ১০০ পাপড় বিক্রি করেন ১০০ টাকায়। এক বস্তা আটা কেনেন এক হাজার ৫০০ টাকায়। দুই মণ খড়ি কেনেন ৬০০ টাকায়। আরও আনুষঙ্গিক কিছু মসলা দিয়ে দুই হাজার ২০০ টাকা খরচ করে পাপড় তৈরি করলে চার হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন।
পাঁপড়ের মতো এ গ্রামের প্রায় ১০০ হিন্দু-মুসলিম পরিবার ঝুরি তৈরি ও বেচাকেনা করে সংসার চালায়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত উভয় পরিবারের লোকজন এ ঝুরি তৈরি করে থাকেন। লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় প্রায় ৪০ বছর থেকে শুরু করে এ পেশায় চলছে তাদের জীবন। বর্ষাকাল ছাড়া প্রায় সব মাসেই এ ঝুরির ব্যবসা হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে মেলায় এ চাহিদা আরও বেড়ে যায়। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জেলা শহর বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা থেকে পাইকাররা এসে এই ঝুরি পাইকারি কিনে নিয়ে যান।
বাড়ির পাশে জমিতে ঝুরি শুকাতে দিয়েছে কারিগর আমজাদ ও মরিয়ম বেগমের পরিবার। ঝুরি শুকানোর জন্য নেড়ে দিচ্ছেন মরিয়ম বেগম। বিভিন্ন রঙের ঝুরি শুকাতে ব্যস্ত তারা। মরিয়ম বলেন, ভোর ৫টা থেকে ঝুরি তৈরির কাজে ব্যস্ত তারা। এটি তৈরি করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। প্রথমে চাল ভিজিয়ে তা দিয়ে মেশিনে আটা তৈরি করা হয়। পরে ওই আটা পানিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে তা আরেক মেশিনের মাধ্যমে লম্বা প্যাঁচানো আকৃতিতে খণ্ড খণ্ড করা হয়। এ খণ্ডাংশকে তিন দিন রোদে শুকিয়ে তেলে ভাজার পর তা খাওয়ার উপযোগী করা হয়। অনেকে বালিতেও ভাজে। কিন্তু বালিতে ভাজতে পরিশ্রম বেশি হওয়ায় বর্তমানে তেলে ভাজা হয়।
কথা হয় সরলপুর গ্রামের ঝুরি ব্যবসায়ী হায়দার আলির সঙ্গে। তিনি বলেন এ গ্রামের জিয়া, লাল, নিলয় চন্দ্রসহ প্রায় ১০০ পরিবারের লোকজন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার কোনো জমাজমি নেই। দীর্ঘ প্রায় ৪২ বছর ধরে তিনি এ ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন এবং সচ্ছলতার মুখ দেখছেন। ঝুরি তৈরির কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অনেক পরিশ্রম করেন।
তিনি আরও বলেন, ৫০ কেজি চালের ঝুরি তৈরি হয় প্রায় ৪০ কেজি। আর ৫০ কেজি চাল দুই হাজার ২০০ টাকায় কেনা হয়। পাইকারি প্রতি মণ ঝুরি চার হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে। খুচরা প্রতি কেজি ঝুরি ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা দরে বেচাকেনা করা হয়। পাইকাররা বাড়িতে এসেই এই ঝুরি কিনে নিয়ে যায়। তবে বর্তমানে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও পুঁজির অভাবে ঝুরি তৈরির লোকের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ ঝুরি ব্যবসার আরও প্রসার ঘটবে।
গোকুল ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য রুমি বেগম বলেন, এ ইউনিয়নের প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ পরিবার এই পাপড় ও ঝুরি তৈরির সঙ্গে জড়িত। এই গ্রামে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজ করে স্বাবলম্বী। এখানকার পাপড় ও ঝুরির কদর ও চাহিদা থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোক এ গ্রামে আসেন পাপড় ও ঝুরি নিতে।