বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হাঁটছে দেশের কূটনীতি

শেখ আবু তালেব: স্বাধীনতার পর প্রথম কাজই ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়। যুদ্ধ চলাকালে ও স্বাধীনতার পরই মাত্র কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত পাওয়া যেত না বৈশ্বিক সহায়তা। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হওয়ায় বঙ্গবন্ধু প্রথম উদ্যোগ নেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের। এভাবেই প্রাচ্য ও পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারসাম্য আনার প্রথম উদ্যোগটি নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একে তো নতুন তার উপরে যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র হওয়ায় সহযোগিতা ও স্বীকৃতি দুটোরই প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। বিষয়টি বুঝতে পেরেই সদ্যজাত রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করেন বঙ্গবন্ধু। অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি নির্ধারণ করেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার। দেশের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করা হয় ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’।

স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরেই এখনও বাংলাদেশ ভারসাম্যের এ কূটনীতির সূত্র অনুসরণ করে চলছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া পররাষ্ট্রনীতির কারণেই কূটনীতিতে এখনও সফলতা পাচ্ছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু আজীবন শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা এখনও সেই সূত্র মেনেই চলছি। আঞ্চলিক ও সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চাই, সকলের সহযোগিতা চাই। সকলকে বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে চাই। এ নীতি এতটা বাস্তবসম্মত কৌশল যে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখনও সেই সূত্র ধরেই আবর্তিত হচ্ছে।’

স্বাধীনতার পর দেশের উন্নয়ন বাজেটের ৯০ শতাংশই ছিল দাতা দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তা। উন্নয়ন সহায়তার বাইরেও খাদ্য সহায়তার পুরোটাই ছিল অনুদানের। এ অনুদানের পুরোটাই পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে আনা সম্ভব ছিল না। চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্তির অপ্রতুলতা ছিল। এজন্য মুসলিম দেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন বঙ্গবন্ধু। যদিও ওই সময়ে এটি কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। মুসলিম একটি দেশ ভেঙে দু’ভাগে বিভক্ত হওয়া, নতুন দেশকে আবার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি এক বিরাট চ্যালেঞ্জের ছিল।

জানা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মুসলিম দেশ হচ্ছে আফ্রিকার সেনেগাল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পাশাপাশি অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোকে আহ্বান জানায় সেনেগাল। আর এশিয়ার দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল শুধু মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এর বাইরে কোনো মুসলিম দেশের নাম তখনও শোনা যায়নি।

স্বাধীনতার পর মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতি আনতে উদ্যোগী হন তিনি। তার দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্ত ও প্রজ্ঞায় এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণ করেন। তার এ কৌশলে একের পর এক স্বীকৃতি আসতে থাকে বাংলাদেশের। স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে মুসলিম দেশগুলো পর্যন্ত।

১৯৭২ সালে একে একে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করে ইরাক, সিরিয়া, আলজেরিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, মিসর, গাম্বিয়া, গ্যাবন, সিয়েরালিওন, দক্ষিণ ইয়েমেন, উগান্ডা, বুরকিনা ফাসো। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক করপোরেশনের (ওআইসি) বার্ষিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগদান করেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে।

এভাবে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর ওপরই নির্ভরশীল না থেকে প্রাচ্যের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারসাম্য আনেন বঙ্গবন্ধু। সেভাবেই এখনও ভারসাম্য করে চলছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানে ক্ষমতা ও শাসন ব্যবস্থার পালাবদল চলছে। এ নিয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সামরিক মহড়া প্রদর্শিত হচ্ছে। দেশটিকে কেন্দ্র করে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো নতুন মেরুকরণের দিকে যাচ্ছে। এজন্য উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে কয়েক রাষ্ট্র মিলে একটি সমাবেশ হয়। সেখানেও আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশলের কারণেই প্রতিবেশী থেকে শুরু করে দূর দেশও বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করছে। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আলোচনা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবস্থানকে অনন্য হিসেবে দেখছে বিশ্ব।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক এরকম সাফল্য অতীতেও দেখিয়েছে। স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পরেই ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এরপরই ১৯৭৮-১৯৮০ সময়সীমায় বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। এখানেও দক্ষতা প্রমাণ করায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। গড়পড়তা প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি সেনাসদস্য বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন এবং এখনও আছেন। বিশেষ করে সোমালিয়া, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক, কুয়েত, বসনিয়া-হারজেগোভিনা, আইভরিকোস্ট, হাইতি, সিয়েরালিওনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের উদার কূটনৈতিক কৌশলের কারণে।