আরফাতুর রহমান শাওন: মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে। জীবনযুদ্ধে প্রতি মানুষই স্বপ্নপ্রিয়াসী। কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন চোখের সামনে ধূলিসাৎ হয়ে যায়, তখন বেঁচে থাকার চাকাটাও মনে হয় থমকে যায়। বঙ্গবাজারে মার্কেটে আগুন মধ্যবিত্ত দোকানিদের স্বপ্ন পানিতে ভাসিয়ে দিল। ঈদের আগে মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে পাগলপ্রায় কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। কেউ যেন কাউকে সান্ত¡না দিতে পারছিলেন না। বঙ্গবাজারের ভেতর ভয়াবহ আগুন নেভাতে পানি দিচ্ছিলেন ফায়ার ফাইটাররা। আর বাইরের চারপাশে অঝোরে কাঁদছিলেন ব্যবসায়ীরা। তাদের চোখের জল যেন ফায়ার সার্ভিসের পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, বছরে ঈদুল ফিতরেই তাদের বিক্রি বেশি হয়ে থাকে। মহামারি কভিডের কারণে গত দুই বছর তেমন বিক্রি করতে পারেননি। আশা ছিল এ বছর তাদের বিক্রি হবে। সেই আশায় অনেকে পুঁজির সঙ্গে ঋণ নিয়ে আবার কেউ কেউ স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে কাপড় কিনে রেখেছিলেন বিক্রির জন্য। মুহূর্তের মধ্যে তার সব শেষ হয়ে গেল। শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, এসব মার্কেটে কর্মরত অর্ধ লাখ কর্মচারী বেকার হয়ে পড়া এবং বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন।
তবে প্রশ্ন উঠছে কেন বারবার আগুন লাগছে? এর সঠিক উত্তর এখনও অজানা। এই অজানা প্রশ্ন ঘিরে নানা কানাকানি। নিমতলীর রাসায়নিক দ্রব্যবোঝাই গুদামঘর, তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো থেকে সীমা অক্সিজেন, হাতিমারা পাথারিয়া থেকে রাজকান্দি বন কিংবা রাজধানীর বঙ্গবাজারÑএকের পর এক প্রশ্নহীন আগুন। নিমিষেই অঙ্গার টাটকা জীবন, বিধ্বস্ত বাস্তুতন্ত্র, চুরমার সংসার, ভস্ম জীবিকা ও বিশৃঙ্খল পরিবার। তদন্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে, মামলা হয়, ক্ষতিপূরণ কিছু দেয়া হয়। কিছু ধরপাকড় চলে। দৃষ্টান্তমূলক কিছুই হয় না। প্রতিবারই দেখা যায়, প্রতিটি ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সর্বস্তরের গাফিলতি থাকে এবং অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে, এমন ঝুঁকি মোকাবিলার কোনো প্রস্তুতিও সেসব জায়গায় থাকে না। বঙ্গবাজার থেকে শুরু করে কারখানা কিংবা বসতবাড়ি বা মজুতাগারের নির্মাণশৈলী এবং অগ্নিনির্বাপণসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা এত দায়সারা কেন?
মার্কেট কিংবা বাসা, বস্তি কিংবা অভিজাত এলাকাÑঅগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন ভবন। একের পর এক আগুনের ঘটনা লেগেই আছে। অথচ প্রতিটি আগুনের ঘটনার পরই তদন্ত কমিটির রিপোর্টে থাকে নানা সুপারিশ। বিল্ডিং কোড বা ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনিরাপত্তায় আছে নানা নির্দেশনা। কিন্তু এসব আইন আর নির্দেশনার থোড়াই কেয়ার করেন ভবন-মার্কেট মালিক আর ব্যবসায়ীরা। তা না হলে যে মার্কেট ২০১৯ সালেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলো, তা এত বছর নির্বিঘেœ চলল কীভাবে!
দেখা যাচ্ছে, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না রেখেই চলছে মার্কেট-কারখানা। নতুন যেগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলোতেও বালাই নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার। এগুলো যারা দেখভাল করবে, সেইসব সরকারি দপ্তরগুলোরও মন নেই কাজে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটি নানা সুপারিশ করলেও তা আলোর মুখ দেখে না। এ কারণে ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে রাজধানী। ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান ও সাবেক দুই মহাপরিচালকের কথায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
ফায়ার সার্ভিস রেগুলেটরি বডিগুলোর এখনও আধুনিক হয়নি। আর এগুলো খুব একটা শক্তিশালীও নয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিরোধে নিরাপত্তা ছাড়পত্র যথাযথভাবে মানতে হবে। আর এরই মধ্যে যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো দ্রুতই ঝুঁকিমুক্ত করার তাগিদ দিতে হবে। যারা বিল্ডিং কোড মানবে না, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমাদের যদি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকে, তবে মানুষ কিন্তু এর সুযোগ নিতেই থাকবে।
কবে আমাদের মার্কেট, ভবনমালিক, কারখানা কিংবা কর্তৃপক্ষের হুঁশ হবে? বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সামগ্রিকভাবে আগুন নেভানো ও জানমালের উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি আশা করি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি আহতের চিকিৎসা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণে কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্র মানবিক ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে এই রমজানের মাসে ও ঈদ উৎসবের আগে যাদের জীবনজীবিকা পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। তাজরীন গার্মেন্টস থেকে সীতাকুণ্ড কিংবা সাম্প্রতিক বঙ্গবাজার প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত গাফিলতি ও অবহেলা প্রমাণিত হলেও রাষ্ট্র মালিকপক্ষকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও দণ্ডের আওতায় আনতে পারছে না। যে কারণে চুড়িহাট্টা থেকে সেজান, কিংবা সীমা অক্সিজেন কারখানা, কিংবা বঙ্গবাজারে পুড়ছে জীবন ও সম্ভাবনা।
বঙ্গবাজারের অবস্থান রাজধানীর খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে। জনবহুল গুলিস্তান-লাগোয়া পুরোনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, মেডিকেল কলেজ প্রভৃতি কত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখানে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড জানান দেয়, এই অঞ্চলে প্রচুর পানি থাকা জরুরি। উš§ুক্ত লেক ও পুকুরে সারাবছর পানি মজুত রাখা যেতে পারে। অগ্নিনির্বাপণে এই পানি কাজে লাগবে, অন্য সময় নাগরিক জীবনে একটুখানি স্বস্তি বিলাবে। তাছাড়া প্রতিদিন উত্তপ্ত হয়ে ওঠা নগরে আমাদের উš§ুক্ত জলাভূমি ও সবুজ বলয় তো জরুরি। মার্কেট, কারখানা, গুদাম কিংবা স্থাপনাগুলোর নিয়মিত তদারকি করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গাফিলতি কিংবা অবহেলা প্রমাণিত হলে তা বিচারের আওতায় আনতে রাষ্ট্র তৎপর হবে আশা করি। সীতাকুণ্ড থেকে বঙ্গবাজার প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড আমাদের সামনে বহু সতর্কবার্তা হাজির করেছে। এসব বার্তাকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না, প্রতিটি বার্তা নানাভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এসব বার্তা আমাদের আরও বেশি সতর্ক, দায়িত্বশীল, দায়বদ্ধ এবং তৎপর হওয়ার কথা জানায়। আমরা কী তা টের পাই? নাকি আরেকটি নির্দয় অগ্নিকাণ্ডে অঙ্গার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি।
শিক্ষক, মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়
বংশাল, ঢাকা