বঙ্গবাজার-নিউমার্কেটের আগুনের উত্তাপ নারায়ণগঞ্জে

আবদুর রহিম, নারায়ণগঞ্জ : আগের মতো হাঁকডাক নেই নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি মার্কেটগুলোয়। কাজ কমে যাওয়ায় বেকার সময় পার করছেন শ্রমিকরা। বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটের আগুনের উত্তাপে পুড়ছে নারায়ণগঞ্জ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে তৈরি পোশাকের বড় একটি অংশ যায় বঙ্গবাজারে। সারাবছর বাকিতে মালামাল বিক্রি হয়। ঈদকে সামনে রেখে এই বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তবে ঈদের আগেই পুরো বছরের বকেয়া পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুনের কারণে তারাও আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন।

জানা যায়, ১৯২০ সালের দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজার ও নয়ামাটি এলাকায় হোসিয়ারি শিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে এ ব্যবসার প্রসার ঘটতে শুরু করে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শহরের দেওভোগে গড়ে ওঠে তৈরি পোশাকের পাইকারি বাজার। প্রায় ২০০ শতাংশ জায়গার ওপর এ মার্কেটে পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে, কারখানা আছে শতাধিক। মার্কেটটিতে মেয়েদের পোশাক বেশি বিক্রি হয়। তবে ছেলেশিশুদেরও পোশাক তৈরি ও বিক্রি হয়।

হোসিয়ারি ব্যবসায়ীরা জানান, নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচ হাজারের অধিক হোসিয়ারি কারাখানা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের এসব কারখানার তৈরি পোশাক ঢাকা ও ঢাকার বাইরে রাজশাহী, কুমিল্লা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি দরে কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর সদরঘাট, নিউমার্কেট ও বঙ্গবাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী পোশাক কেনেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। বঙ্গবাজার, সদরঘাট ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নয়ামাটি, টানবাজার ও দেওভোগের ছোট-বড় কয়েকশ ব্যবসায়ী নিয়মিত লেনদেন করে থাকেন। ঈদের আগে বঙ্গবাজারে আগুন লাগায় এসব ব্যবসায়ী প্রায় শতকোটি বকেয়া টাকা তোলা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন। হোসিয়ারিতে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

নয়ামাটি এলাকায় অবস্থিত মীম হোসিয়ারির মালিক সুজন জানান, প্রায় এক যুগ ধরে বঙ্গবাজারে পাইকারি মাল সাপ্লাই করে আসছি। প্রায় এক কোটি টাকা পাওনা আছে। প্রতিবছর শবেবরাতের পর থেকে ঈদের বিক্রি শুরু হয়, চলে রমজানের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। কিন্তু এ বছর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেল। আমরা নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা দুই দিকে ক্ষতিগ্রস্ত। একদিকে বিশাল অঙ্কের টাকা আটকে গেল, অন্যদিকে বিক্রিও বন্ধ। তিনি জানান, আমাদের যারা পাওনাদার আছে, তাদের আমাদের ঠিকই পাওনা পরিশোধ করতে হবে।

জান্নাত হোসিয়ারির মালিক আবু ইউসুফ চার বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তিনিও বঙ্গবাজারে শিশুদের পোশাক পাইকারি বিক্রি করতেন। তার বকেয়া পাওনা ১৮ লাখ টাকা। 

এদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকায় দোকান রয়েছে দেড় হাজারের মতো, যাদের বেশিরভাগই বঙ্গবাজারের পাইকারি বিক্রেতা। এই ব্যবসায়ীরা আরও জানান, বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় মূল ক্ষতিগ্রস্ত নারায়ণগঞ্জের ব্যাবসায়ীরা। কেননা নারায়ণগঞ্জের পাইকারি মালগুলো বিক্রি  হতো বঙ্গমার্কেটে। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন হোসিয়ারি ব্যাবসায়ীরা বাকিতে মাল বিক্রি করতেন। নয়ামাটি এলাকার ফোর স্টার ফ্যাশনের মালিক শুক্কুর আলী বলেন, ‘গত ১০ বছরে ব্যাবসায়িক লেনদেন করতে করতে ২৬ লাখ টাকা বকেয়া জমেছে বঙ্গবাজারের দোকানিদের কাছে। অগ্নিকাণ্ডের পর বকেয়া টাকা আটকে গেছে। শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সবাই জানে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সব পুড়ে গেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত তো আমরাও হয়েছি। কারণ তারা তো আমাদের মাল নিয়ে বিক্রি করে তারপর টাকা দিত।’

শহরের দেওভোগ মার্কেটের আল-মুজিব গার্মেন্টসের মালিক ব্যবসায়ী হাজী মো. সেলিম বলেন, ‘বঙ্গবাজারে ৩০ জন পাইকারি ক্রেতা আছে আমার। সারাবছরই তারা আমার কাছ থেকে মাল নেয়। এই লেনদেন চলে বাকিতে। ঈদের অন্তত ১০ দিন আগে সব লেনদেন ক্লিয়ার হয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবাজারের আগুনে আমার ৩০ জন পার্টির সবারই মালামাল পুড়ে গেছে। প্রায় এক কোটি টাকা বকেয়া আছে। এখন তাদের এই দুর্দিনে টাকা চাইতেও পারছি না। কিন্তু টাকা না পেলে ঈদের আগে আমি আমার কর্মচারীদের বিদায় করব কীভাবে?’

একই পরিস্থিতি এ মার্কেটের আল-করিম গার্মেন্টসের মালিক আব্দুল মতিন, রুমা গার্মেন্টসের মালিক মুজিবুর রহমান, একে ফ্যাশনের মালিক আবুল কালাম, আওলাদ গার্মেন্টসের মালিক আওলাদ হোসেন, আরপি গার্মেন্টসের মালিক আব্দুল মতিন, নিজাম, পলাশ ও এইচকে ফ্যাশনের হাসিবুর রহমানেরও। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে দুই লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত বকেয়া আছে তাদের। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর বিপাকে পড়েছেন তারা।

দেওভোগ মার্কেটের ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এ মার্কেটের অনেকেই বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে মাল বিক্রি করেন। তাদের কাছে আমাদের ৪০ কোটি টাকারও বেশি পাওনা আছে। এখন তাদের সবকিছু আগুনে পুড়ে যাওয়ায় আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছে পাওনা টাকা চাইতে না পেরে শ্রমিকদের নিয়ে আমরাও বিপদের মধ্যে আছি।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ নাজমুল আলম সজল বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি হোসিয়ারি কারখানা রয়েছে। কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা এখানে। অনেক ব্যবসায়ীর বকেয়া পড়ে আছে বঙ্গবাজারে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর এখানকার ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে করণীয় কী এসব নিয়ে আমরা মিটিং করছি। কে কার কাছে কত টাকা বকেয়া, এটার একটা তালিকা করছি। তালিকা করার পর বিকেএমইএ ও এফবিসিসিআইর সহযোগিতা চাইব।’