আবুল কালাম আজাদ : স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় ও জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আম বাজারে মিলতে শুরু করেছে। চলতি বছরে রংপুরে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরও ২০০ কোটির বেশি টাকার হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
হাঁড়িভাঙা আম শুধু একটি ফল নয়, এটি রংপুরের ঐতিহ্য এবং অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই আমের চাষাবাদ স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে এবং অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। নফল উদ্দিন পাইকারের লাগানো সেই চারা গাছ আজ একটি বৃহৎ শিল্পে পরিণত হয়েছে, যা রংপুরের নাম উজ্জ্বল করছে বিশ্ব দরবারে।
বৈচিত্র্যময় রংপুরের বিখ্যাত সুস্বাদু হাঁড়িভাঙ্গা আম বদলে দিয়েছে ওই এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক ভাগ্য। এক সময় যেখানে সবাই পড়ে থাকতেন ধান, তামাক, সবজি চাষ নিয়ে। কিন্তু এঁটেল মাটির এ এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষ যে অনেক বেশি লাভজনক, সে বিষয়টি বুঝতে পেরে আগে যারা জমিতে ধানসহ অন্য ফসলের চাষ করতেন। তারাও আম চাষে ঝুঁকে পড়েন। লাভ বেশি হওয়ায় আম চাষ হয়ে ওঠে এখানকার মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন।
হাঁড়িভাঙা আম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা: বিষমুক্ত ও অতি সুমিষ্ট আঁশহীন হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। কয়েক বছর ধরে ফলন ভালো হওয়ায় বেড়ে চলেছে আম উৎপাদনের পরিধিও। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিস্তৃত এলাকার ফসলি জমি, বাগানসহ উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে চাষ হচ্ছে এই আম।
এবার রংপুর জেলায় আম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ৩৫৯ হেক্টর। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙা আম এক হাজার ৯১০ হেক্টরের বেশি জমিতে চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে হাঁড়িভাঙা আম প্রায় ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন ফলন হয়।
সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, শেষ সময়ে ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে আম রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এ মৌসুমে তিন দফায় ঝড় হওয়ায় ফলনে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে শঙ্কা করছেন তারা। একই সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক ঝড়ের পূর্বাভাস নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে আমচাষিদের মধ্যে।
মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের আমচাষি বেলাল হোসেন বলেন, এবার গাছে আমের মুকুল এক মাস দেরিতে এসেছে। মুকুল আসার পর থেকে তিনবার ঝড় হয়েছে। ফলে আমের ফলন গতবারের তুলনায় কম হয়েছে। আম পাড়ার আর দেড় মাস সময় বাকি। যদি ফের বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি হয় তাহলে আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ব।
যেভাবে হাঁড়িভাঙার গোড়াপত্তন: হাঁড়িভাঙা আমের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকার নামে এক বৃক্ষবিলাসী মানুষ। স্বাধীনতার আগের বছর ১৯৭০ সালে নফল উদ্দিন পাইকার ১২০ বছর বয়সে মারা যান। এখন তার লাগানো হাঁড়িভাঙা গাছটির বয়স ৭৬ বছর।
নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন জানান, সম্ভবত ১৯৪৯ সাল, তখন তার বাবা নফল উদ্দিন এই গাছটি রোপণ করেছিলেন। উপজেলার বালুয়া মাসুমপুর গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার একটি জমি থেকে দুটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তার বাবা। তবে একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি (ফিল্টার সিস্টেমে) দেয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে।
তিনি জানান, গাছটিতে এক সময় বিপুল পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চান। তখন থেকেই গাছটি হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। এখন হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম মানুষের মুখে মুখে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাগান। তিনি হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটির সংরক্ষণের দাবি জানান।
১৯৯২ সাল থেকে হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারণ শুরু হয় আখিরাহাটের আব্দুস সালাম সরকারের হাত ধরে। শুধু চাষবাদ নয়, এই অঞ্চলের হাঁড়িভাঙা সম্প্রসারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার হাত ধরেই রংপুর অঞ্চলের মানুষ এখন অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভের আশায় উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে প্রতি বছর হাঁড়িভাঙা আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
আব্দুস সালাম সরকার বলেন, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ করছি। টেকসই অর্থনীতির জন্য হাঁড়িভাঙা আমের সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের দাবি করে আসছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই দাবি উপেক্ষিত হলেও আমের উৎপাদন ও বাগান সম্প্র্রসারণ থেমে নেই। সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙাকে ঘিরে এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও চাঙা হবে।
হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য: ভালো মানের হাঁড়িভাঙা আম চেনার উপায় প্রসঙ্গে আমজাদ হোসেন বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের ওপরটা যত কালচে, ভেতরে ততই সুন্দর। এর স্বাদ ও মিষ্টি লোভনীয়। দেখতে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন আমে কীটনাশক ও স্প্রে ব্যবহার বাগান কিনে নেয়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের জন্য করে থাকেন। এতে আম দেখতে ভালো, সুন্দর ও পাকা রঙের মনে হয়।
হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। এই আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আকারভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে।
আম সংরক্ষণে গবেষণার দাবি: চাষিরা বলছেন, হাঁড়িভাঙা আম পাকলে এটি তিন থেকে চার দিনের বেশি রাখা যায় না। সংরক্ষণের কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই। যদি এই আম সংরক্ষণের সঠিক প্রক্রিয়া থাকত, তাহলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হতো।
তরুণ উদ্যোক্তা মেহেদী হাসান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই আমের লাইফলাইন নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু আমরা এখনও এর কোনো সুফল দেখিনি। সম্প্র্রতি হাঁড়িভাঙা আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেলেও স্থানীয়ভাবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অনেক চাষি ও ব্যবসায়ী এই স্বীকৃতির গুরুত্ব সম্পর্কেও অবগত নন।
রংপুর কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের ওপর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে। তবে কবে নাগাদ গবেষণার ফল আসবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। হাঁড়িভাঙার লাইফলাইন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা চলছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (উদ্যান) হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, চলতি বছর রংপুর জেলায় ৩ হাজার ৩৫৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯১০ হেক্টরে চাষ করা হচ্ছে হাঁড়িভাঙা। আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেছেন, ‘জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া হাঁড়িভাঙা আম বাজারজাত করতে এবার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে বিষয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবহনে যাতে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সুবিধার বিষয়টিও দেখা হবে।