ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের নিজস্ব কয়লাখনি বড়পুকুরিয়া, যদিও এর কয়লা কিনতে হয় ডলারে। তবে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই এ কয়লা কিনতে ব্যয় বেড়ে গেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। এরই মধ্যে কয়লার দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ কোল মাইনিং কোম্পানি। আগামী ৩০ ডিসেম্বর বর্ধিত দাম কার্যকরের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে এ-সংক্রান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে জানানো হয়, বড়পুকুরিয়ার প্রতি টন কয়লার দাম বর্তমানে ১৩০ ডলার। তবে ১২ খাতের ব্যয় বিবেচনায় প্রতি টন কয়লার উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৫ দশমিক ৫২ ডলার। এর সঙ্গে ১০ শতাংশ মুনাফা যোগ করে প্রতি টন ১৯৩ ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। যদিও বড়পুকুরিয়ার প্রতি টন কয়লার দাম ১৩২ দশমিক ৮১ ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পিডিবি।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০০৬ সাল থেকে বড়পুকুরিয়ার কয়লা ব্যবহার করছে পিডিবি। সে সময় প্রতি টন কয়লার দাম ধরা হয়েছিল ৬০ ডলার। পরে তা চার দফা বাড়িয়ে ১০ বছরের মধ্যে করা হয় ১৩০ ডলার। এরপর ছয় বছর কয়লার দাম বাড়ানো হয়নি। এজন্য কয়লার দাম পুনর্নির্ধারণে প্রস্তাব দেয় কোল মাইনিং কোম্পানি। এ নিয়ে গত ৯ নভেম্বর জ্বালানি বিভাগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় কোল মাইনিং কোম্পানি প্রতি টন কয়লার উৎপাদন ব্যয় ১৯৪ দশমিক ৪২ ডলার প্রস্তাব করে। এর সঙ্গে ১০ শতাংশ মুনাফা যোগ করে কয়লার দাম ২১৩ দশমিক ৮৬ ডলার চাওয়া হয়। তবে মুনাফা আরও বেশি হলে দাম আরও বাড়বে। তবে সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পিডিবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়লার উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণে কমিটি গঠন করে দেয়া হয়।
ওই কমিটি বৈঠকে উপস্থাপিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম প্রভৃতি যাচাই-বাছাই করে প্রতি টন কয়লার উৎপাদন ব্যয় ১৭৫ দশমিক ৫২ ডলার প্রস্তাব করে। এক্ষেত্রে কোল মাইনিং কোম্পানির প্রস্তাবিত ১৫টি ব্যয় খাত বিশ্লেষণ করে ১২টি রাখা হয় এবং তিনটি বাদ দেয়া হয়।
কমিটির প্রস্তাবনামতে, গত অর্থবছর কয়লা বিক্রি করা হয় চার লাখ ৮৭ হাজার ৯২৬ টন। এতে মোট ব্যয় হয় ৫৮০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন কয়লার উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১১ হাজার ৯০৩ টাকা বা ১৩৮ দশমিক ৩৬ ডলার (১ ডলার=৮৬.০৩ টাকা)। আর প্রতি টন কয়লা পিডিবির কাছে বিক্রি করা হয় ১৩০ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি টন কয়লা বিক্রিতে কোল মাইনিং কোম্পানির লোকসান হয়েছে আট ডলারের বেশি।
এদিকে চলতি অর্থবছর সম্ভাব্য কয়লা সরবরাহের পরিমাণ ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন, আগামী অর্থবছর সাত লাখ মেট্রিক টন, ২০২৪-২৫ অর্থবছর ছয় লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, ২০২৫-২৬ অর্থবছর আট লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, ২০২৫-২৬ অর্থবছর ৯ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর ছয় লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। এ ছয় বছর কয়লা সরবরাহে গড় ব্যয় পড়বে যথাক্রমে ১৮১ দশমিক ৫৫ ডলার, ১৪৪ দশমিক ৩১ ডলার, ২০৭ দশমিক ১০ ডলার, ১৮৩ দশমিক ১১ ডলার, ১৭৯ দশমিক ৮৭ ডলার এবং ১৫৬ দশমিক ৩২ ডলার (১ ডলার=১০৬ টাকা ধরে)। এতে প্রতি টন কয়লার গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ১৭৫ দশমিক ৫২ ডলার।
কয়লার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে কোল মাইনিং কোম্পানি জানায়, এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী খনির উত্তর দিকে কয়লা উত্তোলন করা হবে। এজন্য খনির উত্তরাংশ বর্ধিত করতে ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এজন্য এক হাজার ২০০ কোটি টাকা অবশ্যই লাগবে। এছাড়া চলতি অর্থবছর ১৫ দশমিক ৬৫ একর জমি খনির মধ্যভাগের জন্য অধিগ্রহণ করতে হবে। এজন্য ১১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ ব্যয়কে কয়লার দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এদিকে ২০২৪-২৫, ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছর উত্তরাংশের জমি অধিগ্রহণের জন্য ৪০০ কোটি টাকা করে ব্যয় বিবেচনায় ধরা হয়েছে। আর খনি থেকে কয়লা সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে উত্তরাংশে উš§ুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। এছাড়া জামালগঞ্জ কয়লাখনি ও আলিহাট লৌহ আকরিক খনি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং দিঘিপাড়াসহ অন্যান্য কয়লাক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। এ খাতে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, যা প্রতি বছর সমানভাবে বরাদ্দ ধরা হয়েছে সম্ভাব্য বাজেটে।
যদিও এ দুই বিষয়ে আপত্তি তুলেছে পিডিবি। সংস্থাটি মন্তব্য করে, বর্তমান চুক্তির অধীনে জমি অধিগ্রহণ এবং অন্য কোনো প্রকল্পের অনুসন্ধান ব্যয় বাদ দিয়ে উৎপাদিতব্য কয়লার দাম নির্ধারণ করতে হবে। এতে প্রতি টন কয়লার সম্ভাব্য দাম পড়বে গড়ে ১৩২ দশমিক ৮১ ডলার। কয়লার দাম তাই এ হারেই নির্ধারণ করা উচিত। তবে এ প্রস্তাবে সম্মত হয়নি জ্বালানি বিভাগ।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে মতামত দেয়া হয়েছে। বৈঠকেও তা তুলে ধরা হয়েছে। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জ্বালানি বিভাগ।
তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়েছিল ১১ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৮ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় সাত লাখ ৫৩ হাজার ৯৭৩ মেট্রিক টন। গত অর্থবছর তা আরও কমে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৮৭ হাজার ৮৬৩ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ছয় বছরে কয়লা উত্তোলন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে।
বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিনটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এজন্য প্রতিদিন কয়লার প্রয়োজন সাড়ে পাঁচ হাজার টন। কিন্তু খনিতে বর্তমানে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার টন। এছাড়া খনির যে স্তর থেকে বর্তমানে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, সেখান থেকে প্রতিদিন তিন হাজার টনের বেশি কয়লা পাওয়া সম্ভব নয়। এতে প্রতিদিন ঘাটতি থাকে আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার টন। এর মধ্যে আবার বছরে শিফট পরিবর্তনের জন্য খনির কয়লা উত্তোলন তিন মাস বন্ধ থাকে।
প্রসঙ্গত, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। আর খননকাজ শেষে ২০০৫ সালে ঠিকাদারের কাছ থেকে তা বুঝে নেয়া হয়। ওই বছর ১০ সেপ্টেম্বর থেকে খনি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে পিডিবিসহ বেসরকারি খাতে কয়লা বিক্রি শুরু করা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ থেকে স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে কয়লা বিক্রি বন্ধ রাখা হয়। সে সময় থেকে শুধু পিডিবির কাছেই বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিক্রি করা হচ্ছে।
খনিটি থেকে উত্তোলনের শুরুতে পিডিবির জন্য প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ ডলার। ২০০৮ সালের ১ জুলাই তা বাড়িয়ে ৭০ ডলার, ২০১০ সালের ১ জুলাই ৮৪ ডলার, ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ১০৫ ডলার এবং ২০১৫ সালের ১ মে ১৩০ ডলার দাম নির্ধারণ করা হয়। সে সময় দেশীয় মুদ্রায় প্রতি টন কয়লার দাম পড়ত ১০ হাজার ১৮৬ টাকা। তবে বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে গত জুনে তা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ১৫৫ টাকা।