Print Date & Time : 8 July 2025 Tuesday 8:51 pm

বন্ড সুবিধার অপব্যবহার: ৮০ প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকি ৫৬ কোটি টাকা

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি গোল্ডেন সন লিমিটেড গত বছরের শেষ দিকে এক চালানে বন্ড সুবিধার আওতায় রফতানিমুখী পণ্য তৈরিতে প্রায় ১১ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করে। পরবর্তী সময়ে এ কাঁচামাল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য অবৈধভাবে বাজারজাত করে তিন কোটি ১৬ লাখ টাকার অধিক রাজস্ব ফাঁকি দেয়। এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের একাধিক অভিযোগে গত অর্থবছরে চারটি মামলা করেছে বন্ড কমিশনারেট। এতে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে। গত অর্থবছরে গোল্ডেন সনের মতো আরও ৭৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট অফিসের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্রমতে, হোম কনজাম্পশন ও রফতানিমুখী পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বন্ড সুবিধায় গত অর্থবছরে অভিযুক্ত ৮০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫৭ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্যসামগ্রী খোলাবাজারে বিক্রি করে ৫৬ কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়। আর এসব ঘটনায় গত অর্থবছরের মোট ৯২টি মামলা করে বন্ড কমিশনারেট। এর মধ্যে শুল্ক ফাঁকির ১৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং জরিমানার এক কোটি ১০ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এর মধ্যে ৩১টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে।

বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগে একাধিকবার অভিযুক্ত গোল্ডেন সন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বন্ড কমিশনারেট তো এসআরও না মেনে শতভাগ রফতানি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন। ওনার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্প-কারখানাবিরোধী মনোভাবে বন্ড প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ভয়ে থাকেন। আর নেতিবাচক সিদ্ধান্তের কারণে চট্টগ্রামের অসংখ্য বন্ড প্রতিষ্ঠান বন্ধের পথে। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োজিত হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হতে চলেছে। বন্ড কমিশনারেটের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে গত পাঁচ মাসে আমার বন্ড নিবন্ধন নবায়ন করতে পারিনি।’

এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের বন্ড কমিশনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক। এছাড়া আগামী কিছুদিনের মধ্যে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সঙ্গে বন্ড সুবিধা অপব্যবহার রোধ করা নিয়ে আলোচনা করব।’

চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট গত বছরের বিভিন্ন কারখানায় ব্যাপক অভিযান চালায়। এসব অভিযানে বন্ড সুবিধার বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের অনেক তথ্য মিলে। এর মধ্যে গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজগুলোর ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া যায় বেশি। এছাড়া বড় অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলোর অধীনে আনা শুল্কমুক্ত পণ্যেও অনিয়ম পাওয়া যায়।  প্রতি মাসেই বন্ড সুবিধার আওতায় আনা কোটি কোটি টাকার পণ্যের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অবৈধ কর্মকাণ্ডের মামলা ও শোকজ করা হয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে। আবার এক মালিকের একাধিক নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। তবে অনেক ব্যবসায়ী তাদের বিরুদ্ধে বন্ড কমিশনারের আনা বিভিন্ন অভিযোগের সব সত্য নয় বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) টাস্কফোর্স কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত ৭৩৯ প্রতিষ্ঠান সরাসরি বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে জড়িত। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো খোলাবাজারে ছেড়ে ৭৩৯ প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম করেছে। এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর (বিআইএন বা বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) অকার্যকর এবং আমদানি-রফতানি স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাকশিল্প ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৭৭টি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো প্লাস্টিক, বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদনকারীসহ অন্য খাতের। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের মধ্যে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে প্লাস্টিক দানা, সুতা, কাপড়, পলিথিন, আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, হ্যাঙ্গার, শার্টের কলার ও হাতায় ব্যবহারের শক্ত কাগজ, মিডিয়াম পেপার ও লাইনার পেপার। এছাড়া বৈদ্যুতিক তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, সকেট ও অ্যাডহেসিভ টেপও আমদানি করেছে।

এ প্রসঙ্গে কাস্টমস ও বন্ড কমিশনারেট  কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার আমির মামুন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘রফতানির শর্তে বন্ড সুবিধায় আনা কাঁচামাল খোলাবাজারে অবৈধভাবে বিক্রি করায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়। আর যারা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত অর্থবছরে এ রকম সুবিধার অপব্যবহারকারী ৯২ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেক মামলা নিষ্পত্তি করে রাজস্বও আদায় করা হয়েছে। তবে যাদের অপরাধ গুরুতর তাদের লাইন্সেস আগামীতে বাতিল হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে নিয়মিত তদারকির জন্য সরেজমিন কারখানা পরিদর্শন, মজুদ যাচাই, মূসক ও ডেলিভারি চালান যাচাইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এতে শুল্ক ফাঁকির হার কমছে।’

গত অর্থবছরে মামলা হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠান হলো রিগ্যাল পলি প্যাকেজিং, আর এস সোয়েটার, গোল্ডেন সন, সি বল্টু টেক্সটাইল, স্যানম্যান নিট ফেব্রিকস, হার্বিস কনভার্টিং, ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রি, ইউনিভোগ গার্মেন্টস, সুপার নিটিং অ্যান্ড ডায়িং মিলস, শেং সেং এন্টারপ্রাইজ, রিলায়েন্স ওয়াশিং ইন্ডাস্ট্রিজ, লিবার্টি অ্যাকসেসরিস (বিডি), ইমতি পলি প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি, কেডিএস থ্রেড, জয় জয় মিলস (বাংলাদেশ) প্রাইভেট, স্পার্কল প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্যান অ্যাকসেসরিস ইন্ডাস্ট্রিজ, জেনফোর্ট সুজ (বিডি), টি এইচ পেপার অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্রাইট অ্যাকসেসরিস ইন্ডাস্ট্রিজ, এমআইপি (বিডি), এমি অ্যাকসেসরিস (বিডি), এমআইপি (বিডি), হোলি ইলাস্টিক, এভারগ্রিন প্যাকেজিং অ্যান্ড অ্যাকসেসরিস, জিএবি প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ, সিমস ফ্যাশন, রাস টেক্স ইন্টারন্যাশনাল, যমুনা ইলাস্টিক অ্যান্ড অ্যাকসেসরিস, সুপারথ্রেড। এছাড়া রয়েছে কর্ণফুলী স্টিল মিলস, এস আর প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস, ইনটিমেইট অ্যাপারেলস, কেনপার্ক বাংলাদেশ অ্যাপারেলস, বিডি ডিজাইনস, অর্কিড প্যাকেজিং অ্যান্ড অ্যাকসেসরিস, এইচআরএম অ্যাকসেসরিস, এমি অ্যাকসেসরিস (বিডি), প্রো প্যাকেজিং, এইচ টি আমীন অ্যাকসেসরিস, ভ্যানগার্ড প্যাকেজেস, মেলভিন অ্যাকসেসরিস, সানরাইজ অ্যাকসেসরিস, চিটাগাং কার্টনস, ইয়োগোটেক্স ফেব্রিকস, নিড প্যাকেজিং, চুনজি ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেলমাস অ্যাপারেল, প্রিন্টিং প্রো ডিজাইন, নিউ কার্টন প্যাক, লিবার্টি এন্টারপ্রাইজ, হোলি গার্মেন্টস অ্যান্ড অ্যাকসেসরিস, ফারমিন পলি অ্যান্ড প্যাকেজিং, ইয়াচেন টেক্সটাইল করপোরেশন। তালিকায় আরও রয়েছে হার্বিস কনভার্টিং, লোটস প্যাকেজিং অ্যান্ড অ্যাকসেসরিস, ফরচুন প্যাকেজিং, লিগ্যাসি ফ্যাশন, নূরানী ডায়িং অ্যান্ড সোয়েটার, হাইস্পিড প্যাকেজিং অ্যান্ড অ্যাকসেসরিস ইন্ডাস্ট্রিজ, ফারমিন পলি অ্যান্ড প্যাকেজিং, কেবি ইন্টারলাইনিং কোং, ইউজিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল, নেসা স্প্রিনার, ব্যান্ডিক্স ক্যাজুয়াল ওয়্যার, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, কোটস বাংলাদেশ, রিলায়েন্স বক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ভার্চুয়াল টেক্স, স্যামপ্যাক, এম সি এম্বেল ম্যানুফ্যাকচারিং কোং, আর এন মিলস, গোল্ডেন সন, ইসলাম প্যাক অ্যান্ড অ্যাকসেসরিস, ইউনাইটেড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ, জে এস ইন্টারন্যাশনাল, এরিনা কম্পোজিট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, পালমি সুজ ও জিন চেং শুজ।

এছাড়া চলতি অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত শুল্ক ফাঁকির ১৬ মামলা হয়েছে।