রহমত রহমান: এক বছরে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৬৮ কোটি টাকার কাঁচামাল। শুল্কমুক্ত সুবিধার এই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি করা পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। কিন্তু রপ্তানির কোনো টাকা দেশে ফেরত আসেনি। ফলে এই কাঁচামালের ওপর প্রযোজ্য প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার শুল্ককর পায়নি সরকার। রপ্তানির আড়ালে এই টাকা পাচার করেছে বহুল আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যার লিমিটেড। হাজারীবাগ এলাকার এই প্রতিষ্ঠানটির বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে বিচারাদেশে প্রতিষ্ঠানকে ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) কমিশনার এই বিচারাদেশ দিয়েছেন। তবে রূপালী কম্পোজিট রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৩৮২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ মামলা করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এনবিআর সূত্রমতে, রূপালী কম্পোজিট লেদার ওয়্যার লিমিটেডকে ২০১৫ সালে বন্ড লাইসেন্স দেয়া হয়। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে শতভাগ পণ্য রপ্তানি করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এই প্রতিষ্ঠানটি পণ্য রপ্তানি করলেও রপ্তানির সেই টাকা দেশে আসেনি। কাস্টমস গোয়েন্দা তদন্ত করে যার সত্যতা পায়। পরে ৩৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে ২০১৯ সালে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করে কাস্টমস গোয়েন্দা। একই সঙ্গে কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০২০ সালের ১২ মার্চ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)-কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। সে অনুযায়ী রূপালী কম্পোজিটের বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামালের শুল্ককর নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করে বন্ড কমিশনারেট। কমিটির সদস্যরা কাস্টমস গোয়েন্দা মানিলন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলা ও বন্ড কমিশনারেটের কাছে থাকা নথি পর্যালোচনা করেন।
এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত নিরীক্ষা করা হয়েছে। নিরীক্ষা মেয়াদে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ২৬ হাজার ২৩৪ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। যার মধ্যে ৬ কোটি ১৫ লাখ ৭৪ হাজার ৪৫৩ ডলার প্রত্যাবাসিত হয়েছে। বাকি ৫ কোটি ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৭৮০ ডলার দেশে ফেরত আসেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামালের মূল্য দেখানো হয়েছে এক কোটি ৯১ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩২ ডলার। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কাঁচামালের মূল্য যোগ করে পাওয়া গেছে ১ কোটি ৬৫ লাখ ১৪ হাজার ৫৩১ ডলার। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মূল্য সংযোজনের হার দেখানো হয়েছে ৫২৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি মূল্যে ব্যবহƒত কাঁচামালের মূল্য ৮০ লাখ ১৪ হাজার ১১১ ডলার। এই কাঁচামালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৬৮ কোটি ২৮ লাখ ১০ হাজার ৯৫৫ টাকা। যার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর ১২ কোটি ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার ৫১০ টাকা। প্রতিষ্ঠান প্রযোজ্য এই শুল্ককর
পরিশোধ করেনি। এছাড়া রপ্তানি করা পণ্যের টাকাও দেশে ফেরত আসেনি।
সূত্রমতে, শুল্ককর পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি দাবিনামাসংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠান কোনো জবাব দেয়নি। ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানের প্রথমবারের মতো শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি শুনানিতে অংশ নেয়নি। পরে ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই, দ্বিতীয়বার ১৭ আগস্ট ও তৃতীয়বার ১১ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লিখিত জবাব দেয়নি, শুনানিতে কেউ অংশ নেয়নি। শুনানির বিষয়ে প্রতিবার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন প্রধানিয়া বাহারের মোবাইল ফোন ও চিঠির মাধ্যমে জানায় বন্ড কমিশনারেট। কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি। প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিচারাদেশ দেয় কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)-এর কমিশনার মোহাম্মদ আহসানুল হক। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় এই প্রতিষ্ঠানের বিন লক ও লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যার লিমিটেডের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন প্রধানিয়া বাহার শেয়ার বিজকে বলেন, বন্ডের বিচারাদেশ বিষয়ে আমার জানা নেই।
অপরদিকে, রূপালী কম্পোজিট পণ্য রপ্তানির আড়ালে ৩৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা পাচার করেছে। এ ঘটনার মূল হোতা ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদের, তার স্ত্রী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতানা বেগম। এছাড়া পাচারের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখার ১৩ কর্মকর্তাও জড়িত। মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলার মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। জনতা ব্যাংকের জড়িত কর্মকর্তারা হলেনÑ জনতা ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. রেজাউল করিম (বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি), ডিজিএম মুহাম্মদ ইকবাল, একেএম আসাদুজ্জামান ও কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ, এজিএম মো. আতাউর রহমান সরকার, এসপিও মো. খায়রুল আমিন, মো. মাগরেব আলী, অফিসার ইনচার্জ (এক্সপোর্ট) মোহাম্মদ রুহুল আমিন, সিনিয়র অফিসার ইনচার্জ মো. সাইদুজ্জামান, মো. মনিরুজ্জামান ও মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।
কাস্টমস গোয়েন্দার মামলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখার কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আইন লঙ্ঘন করে ১৯২টি রপ্তানি বিলের বিপরীতে ৩৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। ১৯০টি বিলের প্রাপ্য বিল ৩৭৮ কোটি ৯ লাখ টাকা দেশে আসেনি। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০৮টি রপ্তানি বিল ক্রয় করেছে, যার টাকার পরিমাণ ৪১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। একই বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত ১৬টি বিলের বিপরীতে ২৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ফেরত এসেছে। ফলে এ টাকা সমন্বয় করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রূপালী কম্পোজিটসহ ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধাপে ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস ৪২২.৪৬ কোটি টাকা, রিমেক্স ফুটওয়্যার ৪৮১.২৬ কোটি টাকা ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ ১৫.৮৪ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ৯১৯.৫৬ কোটি টাকা। এই মামলায় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরকে গ্রেপ্তার করে কাস্টমস গোয়েন্দা। এমএ কাদের ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজের চেয়ারম্যান। তার ভাই চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজও এসব মামলার আসামি। আজিজ রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান।
তিন মামলায় বাকি আসামিরা হলেনÑ ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতানা বেগম মনি, রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের এমডি লিটুল জাহান (মিরা), জনতা ব্যাংক লিমিটেডের ডিএমডি (সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন জিএম) মো. জাকির হোসেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ডিএমডি (জনতা ব্যাংক লিমিটেডের তৎকালীন জিএম) ফখরুল আলম, জিএম মো. রেজাউল করিম, ডিজিএম কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ, এ কে এম আসাদুজ্জামান, মো. ইকবাল, এজিএম (সাময়িক বরখাস্ত) মো. আতাউর রহমান সরকার, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (সাময়িক বারখাস্ত) মো. খায়রুল আমিন, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (সাময়িক বরখাস্ত) মো. মগরেব আলী, প্রিন্সিপাল অফিসার (সাময়িক বরখাস্ত) মুহাম্মদ রুহুল আমিন, সিনিয়র অফিসার (সাময়িক বরখাস্ত) মো. সাইদুজ্জাহান, মো. মনিরুজ্জামান ও মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।