বন্ধ হোক গুজব, নৃশংসতা-নির্মমতার বিরুদ্ধে জয় হোক মানবতার

 

কাজী সালমা সুলতানা: দেশজুড়ে গুজব আর অস্থিরতা। রাজধানী থেকে গ্রাম যেন গুজবে আক্রান্ত। একের পর এক গুজবের বিরুদ্ধে নেই কোনো প্রচারণা। কখনও পদ্মা সেতুতে কাটা মাথা লাগার গুজব, তো কখনও ছেলে ধরা, নয়তো রোহিঙ্গা এলো, নতুন গুজব তিনদিন বিদ্যুৎ থাকবে না সে সময় কিছু অঘটন ঘটবে, নানা গুজবে ইউটিউব, অনলাইন সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তোলপাড়। রটনার আতক্সক সর্বত্র। সর্বশেষ গণপিটুনিতে নির্মম মৃত্যু হলো উচ্চশিক্ষিত এক মায়ের। রাজধানীর বাড্ডার এক স্কুলে সন্তানের ভর্তির খবর নিতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন এই মা। হত্যার শিকার হয়েছেন আরও কয়েকজন। একদিনেই মারা গেছেন আটজন। এখন পর্যন্ত সারা দেশে ২৮ জন গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে উৎকণ্ঠিত গোটা দেশের মানুষ।
প্রচারিত সংবাদ থেকে জানা যায় যতটুকু জানা যায়, ইতোমধ্যে সন্তানের সামনে বাবাকে, প্রতিবন্ধী সন্তানের বাবা, বেড়াতে যাওয়া ছয় বন্ধু। বৃদ্ধা, মানসিকভাবে অসুস্থসহ সাধারণ মানুষ এমন নিষ্ঠুর নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন। দেশের প্রতিটা জেলা এমন বিকৃত মানসিক নৃশংসতায় আক্রান্ত। নিছক গুজব এবং সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিষ্ঠুরতায় নিরীহ নিরপরাধ মানুষের জীবন সংহার হচ্ছে। হঠাৎ করে ছেলেধরা আতঙ্ক কেন এলো। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব উদ্ভট গুজবের উৎস কী? করাই বা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে এমন সব গুজব?
বেশিদিন আগের কথা নয়। হঠাৎ করে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের হাজারও মাথা লাগবে’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলল পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি। অবশেষে নির্মাণকাজের চেয়েও গুরুত্ব হয়ে পড়ল এই আজগুবি গুজব ঠেকানো। সেতু কর্তৃপক্ষকেও ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হতে হলো। তারা সতর্ক করে দিল যে, যা কিছু রটানো হচ্ছে, তা নিছক গুজব। একটি মহল এসব গুজব ছড়িয়ে উন্নয়নের মাইলফলক ‘পদ্মা সেতু’র নির্মাণ অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ওই অঞ্চলের অনেকে গ্রামের বিভিন্ন বয়সী মানুষ অপহৃত হচ্ছে বলেও গুজবের উপাদান হিসেবে যোগ করল রটনাকারীরা। কাটা মাথা ও গলা কাটা মানুষের কল্পকাহিনী ছড়িয়ে আতঙ্কিত করে তোলা হলো সাধারণ মানুষকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব আতঙ্ক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব গুজব রটনাকারীদের কি চিহ্নিত করা সম্ভব নয়?
সেই গুজবের রেশ কাটতে না কাটতেই এলো ছেলেধরার গুজব। আজ একজন সহকর্মী বলছিলেন, তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে দিতে যান। আজ তার ছেলেকে বলছিলেন, বাবা তুমি বাইরে এলেই সব সময় আমার কাছে কিছু কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করো। না কিনে দিলে তুমি কান্নাকাটি করো। যদি অমন করে কান্নাকাটি করো, তা হলে রাস্তার মানুষ আমাকে ছেলেধরা মনে করে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। সেই ছোট্ট শিশুটি বাবার কথা উত্তরে জানিয়ে দিয়েছে, সে আর কখনোই কিছু কিনতে চাইবে না। এ থেকেই বুঝা যায় কতটা আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ, আর শিশু শ্রেণিতে পড়–য়া ছোট্ট শিশুটির ওপর এমন নৃশংস ঘটনাবলি কতটুকু প্রভাব ফেলেছে। এই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ কীভাবে আমরা প্রত্যাশা করব?
পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। আগের সেই কলম ভেঙে দস্তখত দিতে পারার শিক্ষিত নয়, প্রকৃতপক্ষেই স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীর হিসেবেই শিক্ষার এ হার। কিন্তু সমাজে এর প্রতিফলন কোথায়? শিক্ষিত মানুষ উদ্ভট গুজবে কান দেবে কেন? আর সেই গুজবের কারণে সন্তানকে খুঁজতে আসা মাকে কেন নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হতে হবে? শিক্ষা গ্রহণ করে সামাজিক দায়িত্ববোধ কেন জাগ্রত হবে না? তা হলে কি মূল্য আছে এই শিক্ষার? সমস্যাটি কি তাহলে শিক্ষার ক্ষেত্রে? নাকি আইনের শাসনের ক্ষেত্রে। আইনপ্রয়োগের দুর্বলতার ক্ষেত্রে? নাকি সামাজিক সংস্কৃতিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে? এসবের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। দাবি করা হচ্ছে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উন্নয়নের সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঘটছে? নাকি অসুস্থ উপায়ে বিত্তবৈভব সংগ্রহকে উন্নয়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হবে? অর্থনীতি সমাজের অবকাঠামো। সামাজিক অস্থিরতা উপরি কাঠামোতে অবস্থান করে। অবকাঠামোতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকলে সমাজে অস্থিরতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে সামাজিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সামাজিক অস্থিরতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা নিয়ে কীভাবে সমাজ এগিয়ে যাবে তাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। না হলে শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীর শ্লীলতাহানি এবং হত্যাকাণ্ড ঘটবে কেন? নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটবে কেন? শিশুরা কেন শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণ-বলাৎকারের শিকার হবে? প্রতিদিনই ধর্ষণে কুৎসিত বিকৃত সংবাদ পড়তে হবে কেন? প্রকাশ্য দিবালোকে প্রধান সড়কের ওপর বরগুনায় কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটবে কেন? মাদরাসার শিক্ষক থেকে মসজিদের ইমাম শিশু ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত? কোথায় চলেছি আমরা? এটি কোনোভাবেই আধুনিক সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়।
গুজব ও সমাজের ঘটমান পাশবিক নির্যাতন ও নৃশংসতা নিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী বাহাদুর রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করছেন। এর পেছনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততার কথা বলছেন। হতে পারে মন্ত্রী বাহাদুরদের কাছে গোপন তথ্য আছে। আর তা যদি থাকে তার সমাধান প্রয়োজন। জনগণের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বাইরেও কিছু আছে বলে অনুমিত হয়। সেই কিছু হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক ঘটনার সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীদেরও সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে।
একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে কি কল্পনা করা সম্ভব যে, একজন মানুষকে কিছু মানুষ মিলে লাঠি, রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে আর কিছু মানুষ নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছে। এতগুলো মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগল না যে, পিটিয়ে হত্যা করার চেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে বা ছেলে ধরা বন্ধ করতে পুলিশের হাতে তুলে দিই। পুলিশের ৯৯৯ নম্বর সম্পর্কে অতগুলো মানুষের কেউ জানল না? এটা কি একটা সভ্য সমাজের সুস্থ সমাজের চিত্র হতে পারে? তাহলে কি পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার কোনো ঘাটতি রয়েছে?
গুজব সব সময়ই একটি অসুস্থ চিন্তার ফসল। যারা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য গুজব রটিয়ে থাকে, তারা কোনো না কোনো ফায়দা লুটার আশায় করে। তারা কোনো সামাজিক জীব হতে পারে না। তাই গুজবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বৃহৎ সামাজিক (রাজনৈতিক হলেও প্রকৃতপক্ষে সামাজিক দায় রাজনৈতিক দলের ওপর বর্তায়) সংগঠনগুলোকেই উদ্যোগী হতে হবে। পাড়া-মহল্লায় ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন ও নেতারা রয়েছে। গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে জাতীয়ভাবে গুজব রটনাকারীদের চিহ্নিত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সমাজকে দ্রুত সুস্থ মানবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় মানুষের প্রাণসংহার যেমন বাড়বে, একই সঙ্গে সমাজকে এগিয়ে নেওয়া, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে। বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়ে সমাধানে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com