নাজমুল হুসাইন: দরজায় কড়া নাড়ছে কোরবানির ঈদ। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ফ্রিজের (রেফ্রিজারেটর) বিক্রি বেড়ে যায়। কোম্পানিগুলোও বিক্রি বাড়াতে এ সময় বিভিন্ন ছাড় ও সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে এ বছর ফ্রিজের বিক্রির চিত্র অনেকটা ভিন্ন। বিভিন্ন ছাড়-অফার থাকলেও বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে অনেক কম। বন্যার কারণে গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বিক্রি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে, এমনটাই মনে করছেন বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোরবানির পশুর মাংস সংরক্ষণের জন্য মূলত এই সময়ে ফ্রিজ (রেফ্রিজারেটর) ও ডিপ ফ্রিজের (ফ্রিজার) বেচাকেনা অনেক বাড়ে। ফলে সারা বছর যে পরিমাণ ফ্রিজ বিক্রি হয়, তার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই এই সময়ে বেচা-কেনা হয়। মৌসুমি এ চাহিদার পাশাপাশি দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ও সংযোগ বাড়ায় ফ্রিজের বাজার অনেক বড় হয়েছে। গত দুই-তিন বছরে ফ্রিজের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
তবে চলতি বছর এ বিক্রি প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। কোরবানির দুই সপ্তাহের কম সময় বাকি থাকলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়নি। আগের বছরগুলোর মতো এতটা ক্রেতা আনাগোনাও নেই দোকান-শোরুমগুলোতে। ফলে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা করছে কোম্পানিগুলো।
হঠাৎ ভরা মৌসুমে এসে ফ্রিজের বিক্রি কমার প্রধান কারণ হিসেবে বন্যাকে দায়ী করছেন বিক্রেতারা। চলমান বন্যার কারণে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি নেমেছে তলানিতে। এছাড়া চলতি বন্যা ও বিগত সময়ে অতিবৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। ফলে এখন ফ্রিজের সব থেকে বড় ক্রেতা মফস্বলের মধ্যবিত্তরা পণ্য ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। কারণ তাদের উপার্জন অধিকাংশই কৃষিনির্ভর। এতে বিক্রি কমেছে।
গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়াম মার্কেটে ভিক্টর ইলেক্ট্রনিকসের অংশীদার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গত বছর কোরবারি ঈদের আগে এমন সময়টাতে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি থেকে ৩৫টি ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এ বছর তার অর্ধেকও হচ্ছে না। গত সোমবার সারাদিনে আমাদের শোরুমে মাত্র ১৭টি ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) দুপুর পর্যন্ত বিক্রি করেছি মাত্র সাতটি ফ্রিজ। বিগত দু-তিন বছরের মধ্যে প্রথম এ বছর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’
একই মার্কেটে বিদেশি কয়েকটি ব্র্যান্ডের ফ্রিজের আমদানিকারক ইমরান গ্রুপের ম্যানেজার আরিফ খান বলেন, ‘ফ্রিজ আমদানি করে সারা দেশে সরবরাহ করে থাকি আমরা। কিন্তু এ বছর যেসব এলাকায় বন্যা হয়েছে, সেসব এলাকায় ফ্রিজ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামগঞ্জে এবার ফ্রিজের চাহিদা খুবই কম। সেখান থেকে ক্রেতা আসছে না বললেই চলে।’
দেশি ফ্রিজ নির্মাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ রেফ্রিজারেটরস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে গত বছর ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এর আগে ২০১৫ সালে বিভিন্ন ধরনের ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে ১৮ লাখ ও ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ। অর্থাৎ এ সময় ফ্রিজের বাজার বেড়েছে ছয় লাখ ইউনিট বা ৫০ শতাংশ। এ বছর বিক্রি ২০ লাখ ইউনিট ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করেছিলেন ব্যবসায়ীরা, যা এখন থমকে গেছে।
ব্যবসায়ীদের হিসাবমতে, সারা বছরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যত ফ্রিজ বিক্রি হয় তার ৩০-৪০ শতাংশই হয় কোরবানি ঈদে। বাজারে ১০০ থেকে ৪০০ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ফ্রিজ পাওয়া যায়। তবে বিক্রি বেশি হয় ১৫০-২০০ লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্রিজের, যা মধ্যবিত্ত মানুষের বেশি পছন্দ। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষমতার ৭০ শতাংশ ফ্রিজারের বিক্রিও হয় এই সময়।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি ও বিদেশি সব ব্র্যান্ডের ফ্রিজেরই বিক্রি কমেছে। সিঙ্গার, এলজি বাটারফ্লাই, সনি র্যাংস, হিটাচি, শার্প ও ট্রান্সকমের মতো ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে ক্রেতা নেই। অপরদিকে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পছন্দের দেশি ব্র্যান্ড যমুনা, মাইওয়ান, ওয়ালটন ও ভিশন মিডিয়ার শোরুমেও নেই ভিড়, যদিও অনেক কোম্পানির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছিল ঈদের বাড়তি প্রস্তুতি। নগদ ছাড়সহ নানা উপহার সামগ্রী দিয়ে বিভিন্ন লোভনীয় অফারেও মিলছে না কাক্সিক্ষত ক্রেতা।
রাজধানীর ইস্কাটনে সিঙ্গার বাংলাদেশের শাখা ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যে হারে বিক্রির কথা ছিল, সে তুলনায় কম বিক্রি হচ্ছে। ২০১৩ সালের পর থেকে এত কম বিক্রি কোনো ঈদেই হয়নি।’
দেশে শার্প ও মিটসুবিসি ব্র্যান্ডের আমদানিকারক এস্কোয়ার ইলেকট্রনিক্স। জানতে চাইলে এস্কোয়ারের মহাব্যবস্থাপক (সেলস ও মার্কেটিং) মনজুরুল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চাহিদা বাড়ায় গত কয়েক বছরে ফ্রিজ উৎপাদন ও আমদানি বেড়েছে। এ সময়ে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ক্রেতার সংখ্যাও বেড়েছে। এ শ্রেণির মানুষের ফ্রিজের চাহিদা মাথায় রেখে কোম্পানিগুলো ফ্রিজ ও ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বন্যা ও ফসলহানির জন্য এ বছর বিক্রি কমেছে। দেশের বাজারে ১০০ থেকে ৪০০ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ফ্রিজ পাওয়া যায়। তবে বিক্রি বেশি হয় ১৫০-২০০ লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্রিজ, যা মধ্যবিত্ত মানুষের বেশি পছন্দ।’