বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস আজ

বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

মো. জিল্লুর রহমান:বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকুলের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ৩ মার্চ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস পালন করে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। মূলত ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০১৪ সালে প্রথম এ দিবসটি পালন করা হয়। আসলে আমরা প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতিও আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। সুন্দর এই প্রকৃতি ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বন ও বন্যপ্রাণী। প্রকৃতির এ অমূল্য সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। সে দায়িত্ব শুধু যে বন্যপ্রাণীর জন্য তা-ই নয়, কোনো না কোনোভাবে মানুষের অস্তিত্ব ও টিকে থাকার জন্যই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা জরুরি।

বন ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকার যেমন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে, তেমনি বন রক্ষার সঙ্গে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি শিল্পোন্নত দেশগুলো কর্তৃক অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের মাধ্যমে অবাধে কার্বন নিঃসরণের ফলে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই হয়নি, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বন ও বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হাতি, বাঘসহ অনেক মূল্যবান প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির হুমকিতে পড়ছে। পাশাপাশি শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে একের পর এক প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড় করায় ক্রমেই বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে সার্বিকভাবে কৃষি বিশেষ করে ধানসহ পানিনির্ভর কৃষির রোপণ প্রক্রিয়া এবং এর উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে বন, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৫.৫৮ শতাংশ এবং এর মধ্যে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের প্রায় ১০.৭৪ শতাংশ। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট আয়তনের ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশএ উন্নীত হয়েছে; যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশের বেশি উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, কৃষিভূমি সম্প্রসারণ, আবাসন প্রভৃতি নানা কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। ফলে দেশের বন ও বন্যপ্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম বনভূমি পরিবেষ্টিত দেশগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে বনভূমির হার মাত্র ১০.৭৪ শতাংশ। আইন প্রয়োগে ঘাটতির কারণে নির্বিচারে বন নিধনের ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ভাওয়ালের শালবন এবং এরই মধ্যে বনটির প্রায় ৯০ শতাংশ হারিয়ে গেছে। এমনকি বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সক্ষম পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন নির্বিচারে গাছ নিধন, উজান থেকে মিষ্টি পানি প্রবাহে ঘাটতির কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এরই মধ্যে হুমকির সম্মুখীন; লবণাক্ততার ফলে ব্যাপকভাবে সুন্দরী গাছের আগা মরে যাচ্ছে।

জীববৈচিত্র্যের এক বিপুল সম্ভার সুন্দরবন ৪৫৩টি প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল, যেগুলো আজ বিপন্নপ্রায়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা একসময় ৪০০-৪৫০টি থাকলেও অপ্রতিরোধ্য চোরাইভাবে পাচারের ফলে বর্তমানে তা ১০০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে। উপরন্তু পরিবেশ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ৫-এর অধীনে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্ট ও এর চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বা বাফার জোন ঘোষণা করা হলেও এর ভেতর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বহুগুণে বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য কখনই কাম্য হতে পারে না।

আমাদের অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে ইতোমধ্যেই উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির এক বিরাট অংশ হারিয়ে গেছে প্রকৃতি থেকে, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়নসহ নানা প্রকৃতিক দুর্যোগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই বিশ্ব আজ সোচ্চার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে। এতদসত্ত্বেও এখনও প্রতিদিন উজাড় হচ্ছে ২ লাখ একর বন আর ১৫০-২০০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী! এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো সচেতনতার অভাব। গৃহপালিত প্রাণী বাদে বনে বসবাসরত সব প্রাণীই বন্যপ্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। দেয়ালের টিকটিকি থেকে শুরু করে আঙিনায় বিচরণকারী কাক, চড়ুইও বন্যপ্রাণী। বন হলো বন্যপ্রাণীর আবাস ও অভয়ারণ্য। ক্রমাগত বন ধংসের ফলে বন্যপ্রাণী খাদ্য সংগ্রহ আর আশ্রয়ের খোঁজে লোকালয়ে এসে পড়ে আর মানুষের হাতে প্রাণ হারায়। বন্যপ্রাণীরাও জানে, লোকালয়ে হানা দিলে তাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। তথাপি তারা একপ্রকার অনন্যোপায় হয়েই খাদ্য সংগ্রহ করতে লোকালয়ে আসে। বুনো ফল-ফলাদি আজ শহরের ফলের দোকানে বিক্রির জন্য সজ্জিত। প্রাকৃতিক বন উজাড় হওয়ার পথে। তাহলে ওরা টিকবে কী করে?

সামান্য মৌসুমি ফল রক্ষায় মানুষ আজ কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখে আর তাতে জড়িয়ে প্রাণ হারায় নিরীহ পাখিরা। ক্ষতিপূরণের বিধান থাকা সত্ত্বেও গুটিকতক বুনোহাতির কবল থেকে ফসল রক্ষা করতে বিদ্যুতের ফাঁদ পাতা হয়, যাতে জড়িয়ে প্রাণ হারায় বুনোহাতি। কতটুকু অসহায় হলে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে হানা দেয়, তা মানুষের অনুধাবন করা উচিত। কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ আছে, যাদের হাজার রকম খাবার বাদ দিয়ে নজর পড়ে বন্যপ্রাণীর দিকে। আর তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য ঘৃণিত ও আইনবহির্ভূত পেশা বেছে নিয়েছে কিছুসংখ্যক শিকারি। অতিথি পাখিরা পরিবেশের উপকার করে, পরিবেশের পরম বন্ধু। এরা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খায়। অথচ পাখি শিকারিরা এদের ধরে বিক্রি করে। এদের নিষ্ঠুর প্রতারণা ও বলির শিকার হয়। কিছু মানুষের আবার আছে বন্যপ্রাণীর দেহাংশ সংগ্রহ করে শো-পিস হিসেবে প্রদর্শন করার অভ্যাস।

ফলাফল, মানুষের লোভের কারণে বনভূমি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির বন্ধু এসব বন্যপ্রাণী। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ আর পরিবেশের অন্যান্য উপাদান দিয়ে। একেকটা বন্যপ্রাণী যেন একেকটা পুঁতি বা প্রকৃতির নক্ষত্র। নক্ষত্র বা পুঁতির মালা ইতোমধ্যেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। প্রতিশোধ হিসেবে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। বজ্রপাত, সুনামি, সুপারসাইক্লোনসহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ সময়ে-অসময়ে হানা দিয়ে জীবন-জীবিকা তছনছ করে দিচ্ছে।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতি হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ কার্যকর করা হয়েছিল। যে ক’টি দেশ জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনটি বাস্তবায়নের জন্য আইন কার্যকর করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, পাস করা হয়। এ আইনে বন্যপ্রাণী হত্যা ও শিকারের জন্য বিভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে। তাছাড়া ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বায়োলজিকাল ডাইভারসিটি অ্যাক্ট পাস হয়েছে। বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডের ৫ শতাংশের বেশি এবং সমুদ্র অঞ্চলের প্রায় ৫ শতাংশ এলাকাকে ‘ঝুঁকিতে থাকা’ এবং সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে।

আসলে রহস্যময় প্রকৃতির প্রতিটি বিষয় সুনির্ধারিত। সৃষ্টিকর্তা জগৎ সৃষ্টি করে পরিবেশ অনুযায়ী জীব সৃষ্টি করেছেন এবং যাকে যেখানে শোভা পায় সেখানেই স্থাপন করেছেন। যেসব প্রাণী বনজঙ্গলে বসবাস করে তারা প্রকৃতির বন্ধু, বনের পশুপাখির বেলায় লোকালয়ে রেখে যতই আদর যতœ করে পোষা হোক না কেন, এতে সে তৃপ্ত নয়। সে চায় যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াতে। লোকালয় এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতেও প্রতিবন্ধকস্বরূপ। বন্য জীবজন্তুর বন্য রূপের সঙ্গে পরিচিত হতে পারা যায় শুধু বনেই। বনেই এদের যথার্থ স্থান এবং সেখানেই তাদের সব সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করলে প্রতিটি প্রাণী সংকুচিত, ভীত ও বেদনায় নুয়ে পড়ে। পরিবেশ অনুযায়ী প্রতিটি প্রাণীই দেখতে সুন্দর। বন্যেরা বনেই সুন্দর আর শিশুরা মায়ের কোলে। জীবজগতের প্রতিটি প্রাণীরই একটি নিজস্ব জগৎ আছে। সে জগতেই সে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। অন্যথা হলে জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়।

বন্যপ্রাণী থাকে বনে, লোকচক্ষুর আড়ালে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিজেদের জটিল কিছু রোগ আছে। কিছু মানুষের বিকৃত খাদ্যাভ্যাসে আর তাদের সান্নিধ্যে আসার ফলে নিরাময় অযোগ্য এসব রোগ মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি ধর্মেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় বিশ্বের সব নাগরিককে সোচ্চার আর সচেতন হতে হবে। যেখানেই বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত হবে সেখানেই স্থানীয়দের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এসব অপরাধীর সংখ্যা খুবই অল্প। এজন্য নতুন প্রজš§কে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে কাজটা খুব সহজ হবে আর ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে নিরাপদ। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়েÑ এ কথাটি তাদের শিক্ষা দিতে হবে। তাহলেই আমরা পাব জীববৈচিত্র্যবান্ধব বাংলাদেশ এবং নিরাপদ হবে পৃথিবী, নিরাপদ থাকবে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি।

ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক

ুৎনননঢ়Ñমসধরষ.পড়স