Print Date & Time : 10 August 2025 Sunday 10:02 pm

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতীকের মৃত্যু

কাজী সালমা সুলতানা: আমার কলিজার টুকরা, আমার আদরের একমাত্র ভাই, আমার প্রতীক আর নাই… শাহজালাল বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগকে আমি ছাড়ব না, অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছেলেটাকে বিভিন্ন ইস্যু বানিয়ে মাস্টার্সে সুপারভাইজার দেয় নাই বিভিন্ন কোর্সে নম্বর কম দিয়েছে। আমার ভাইটা টিচার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, এটাই তার অপরাধ… গত ছয় মাস ধরে ডিপার্টমেন্ট তিলে তিলে মেরে ফেলছে আমার ভাইকে… আমার কলিজার টুকরা কষ্ট সহ্য না পেরে কাল সুইসাইড করেছে…।
ছোট ভাই প্রতীকের আত্মহত্যার জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষকদের দায়ী করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তা তাওহিদা।
তাইফুর রহমান প্রতীক ২০১১-১২ সেশনের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল সে। ইচ্ছা ছিল মাস্টার্সে একই রকম ভালো ফল করে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হবে। কোনো এক কারণে প্রতীকের চূড়ান্ত সফলতা অর্জনের পথ কঠিন হয়ে পড়ে। এদিকে প্রতীকের বোন ছোট ভাইয়ের আত্মহননের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন। তার মতে, ভাইয়ের যোগ্যতা থাকলেও কৌশলে তাকে বিভাগের শিক্ষক হতে দেওয়া হয়নি। প্রতীকের বোনের ভাষায়, ‘আমার ভাইটারে গত মাসেও আমি জিজ্ঞেস করেছি, আমি কি তোর বিভাগের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করব? আমার ভাই বলেছে, আপু আমি জিআরআই দিয়েছি, আমি ইউকে চলে যাব, আমার তো রেফারেন্স লাগবে! শিক্ষকরা ভয় দেখাইছে কিছু করলে রেফারেন্স লেটার দেবে না…।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটা বেড়েছে। এ আত্মহত্যার মিছিলে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। কখনও শিক্ষাব্যবস্থা উপলব্ধি করাতে বাধ্য করে যে, ভালো ফল ছাড়া শিক্ষার্থীর জীবন মূল্যহীন। তখনও তারা কোনো উপায় না দেখে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। এজন্য প্রকারান্তরে শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠা করেছে, প্রথম হতেই হবে! সমাজ ও পরিবারের ভীষণ চাপের মুখে প্রত্যাশিত অর্জন না হওয়ায় অনেকে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।
বাস্তব জীবনে সার্টিফিকেট শিক্ষার্থীদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে না, এ কথাটি উপলব্ধি করতে পারছেন না শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর অভিভাবকরা। পুরোটাই একতরফাভাবে বইতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ফলে চারদিক থেকে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।
বস্তুত বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দ দেওয়ার পরিবর্তে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আনন্দহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিনই শিক্ষার্থীরা অকালে ঝরে যেতে থাকবে।

সমাজে একই দুর্ঘটনা যখন ঘটতে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার কারণ উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। এ কথা মানতেই হবে বেশ কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থী আত্মহননের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সমাজে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।
একটা সময় ছিল যখন শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম করে সব প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলত। বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা থাকলেও সেই মনোবলটা দেখা যায় কম। জীবনে স্বপ্ন দেখে সব মানুষই, সেই স্বপ্ন কখনও আঘাত পায়, কখনও ভেঙে যায় আবার নতুন আশার সঞ্চার হয়। এক দরজা বন্ধ হলে একাধিক দরজা খুলে যায়। তার জন্য শক্ত মনোবলের গুরুত্বও অনেক। একমাত্র পরিবারই পারে সন্তানকে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার মনোবল সৃষ্টি করতে। জীবন একটাই সে জীবনে একটা স্বপ্ন পূরণ না হলে জীবনটাই বৃথা, এমন ধারণা ঠিক নয়। তার জন্য মেধা বিকাশের পাশাপাশি শক্ত মনোবল গড়ে তোলার গুরুত্ব কম নয়।
আমাদের অভিভাবকরা সন্তানের পড়াশোনা-ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন থাকলেও সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না। সন্তান যে কোনো কঠিন সময়ের মুখোমুখি হলে তাকে তাৎক্ষণিক পরামর্শ ও প্রতিকারের বিষয়টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলে এমন বেদনাদায়ক পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কোনো না কোনো একটা উপায় বের হয়ে আসত। তবে বর্তমান প্রযুক্তির সময়ে নতুন প্রজন্ম যেন নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। কেউই নিজের সমস্যা অন্যের কাছে খুলে বলতে চায় না, সে তার যতই নিকটজন হোক না কেন। পরিবারের নিকটজন, বন্ধু-সাথী কারও নৈকট্য এসব প্রতিকূল অবস্থা থেকে মুক্তির পথ দেখায়। আবার বাস্তবিকভাবে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে শিক্ষক কর্তৃক নানা অসহযোগিতা, বিড়ম্বনা ও অপমানের ঘটনা ঘটে। শুধু বর্তমান সময়ে নয়, আশি-নব্বই দশকেও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নানা অভিযোগের কথা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছেও শোনা যায়। যার প্রতি ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী শিক্ষকের পক্ষপাতিত্ব থাকে, তাকেই যেনতেন উপায়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার অভিযোগ আছে। শিক্ষকদের এই অপচর্চা বাড়তে বাড়তে এখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এটা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত । সত্যিকার মেধাবীদের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার আছে। কোনো এক বা একাধিক শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতায় শিক্ষার্থীর মেধার অবমূল্যায়ন শিক্ষার্থীকে হতাশ করবেই। প্রতীক যে কারণে নিজের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল, একই কারণে অনেক জীবন নিভে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন মৃত্যু যেন না ঘটে, তার নিশ্চয়তা দিতে কর্তৃপক্ষকে কারণগুলো শনাক্ত করে এর বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো আজ প্রতীক চলে গেল, কাল হয়তো আরও কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী হারিয়ে যাবে। তখন প্রতীকের বোনের মতো আরও কোনো বোন বলবেন
আমার ভাইরে মেরে ফেলছে ওরা …
আমি কই পাব আমার টুকরারে …?

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com