বসন্ত উৎসব বরণ করতে প্রস্তুত রাজশাহী কলেজ

মেহেদী হাসান, রাজশাহী: কবি পূরব ব্যানার্জি লিখেছেনÑবসন্ত এসে গেছে আজি এই ফাল্গ–নে! শিমুল পলাশে ধরেছে রং! আম্র মুকুলে ওই মৌ গুঞ্জনে, চারিদিকে প্রকৃতির মনমোহিনী রূপের বরষণে! বসন্ত এসে গেছে কোকিলের কুহুতানে। শুধু বৃক্ষ ও প্রাণীর প্রাণে নয়, ইটপাথরের দেয়ালেও ফুটে উঠেছে বসন্তের রূপ। রংতুলির আঁচড়ে বাহারি সাজে সেজেছে লাল ভবনের রাজশাহী কলেজ। শত বছরের পুরোনো পাথর যেন হাসছে। তাদের গায়ে রাঙিয়ে দেয়া হয়েছে লাল, নীল, সবুজ ও হলুদ রং।

কলেজের সবচেয়ে পুরোনো প্রশাসন ভবন থেকে সব চত্বর রঙে রঙিন করা হয়েছে। জনা তিরিশ ছাত্র-ছাত্রীর হাতে চিকন ও মোটা ব্রাশ। রঙের কৌটা সবার হাতে। ওড়নার আঁচল কোমরে জড়িয়ে ছাত্রীরা মনোযোগ দিয়েছেন আলপনা আঁকার কাজে। তারা কলেজের বাংলা বিভাগের অগ্নিবীণা সাহিত্য পরিষদের সদস্য।

অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল খালেকের নির্দেশনায় বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইকবাল হোসেনের তত্ত্বাবধানে সাজিয়ে তোলা হয়েছে ফুল পাখি পাতার আলপনা। দৃষ্টিনন্দন এ আলপনা যেন সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। মনের তৃষ্ণা যেন চোখের সঙ্গে আলিঙ্গন করছে।

কলেজের ফুলার ভবন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন ভবন, শেখ রাসেল দেয়ালিকা ও রবীন্দ্র-নজরুল চত্বরে শোভা পাচ্ছে রংতুলির নিখুঁত ছোঁয়ায় আঁকা এ সৌন্দর্যের কারুকাজ আলপনা। বাদ পড়েনি স্বাধীনতা চত্বর, পেন্সিল কর্নার, শহিদ কামারুজ্জামান ভবনের সামনের সড়ক থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে-পেছনের অংশসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এসব স্থানে বাঙালি ও লোকশিল্পের আলপনা চকচক করছে।

জানা যায়, বাংলার আলপনায় চিরাচরিতভাবে ভেজা চালেরগুঁড়া সাদা রং হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া তেল-সিঁদুর লাল ও হলুদবাটা হলদে রং হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। সাধারণত চালের গুঁড়ার পিটালির মধ্যে ছোট এক টুকরো কাপড় কিংবা পাটের টুকরো ভিজিয়ে নিয়ে অনামিকা দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। আলপনার ছবিগুলো পুরু রেখায় তৈরি ও দ্বিমাত্রিক। সাধারণত মেঝের ওপর আলপনা করা হয়। স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলার নারীরা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদির উদ্দেশ্যেই আলপনার অনুশীলন করে আসছেন। বিষয়বস্তু হিসেবে আলপনায় আঁকা হয় পদ্ম, ধানের গুচ্ছ, বৃত্তায়িত রেখা, সূর্য, মই, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, শ্রীকৃষ্ণের শিশু পদচিহ্ন, মাছ, পান, শঙ্খলতা প্রভৃতি। বর্তমানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আলপনা এঁকে থাকেন।

আলপনায় যুক্ত থাকা শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতি বছর বসন্ত বরণ উপলক্ষে কলেজে আলপনা আঁকা হয়। এর অংশ হিসেবে চলতি বছরও বসন্তের আবাহনে আলপনা আঁকা হচ্ছে। আমরা আনন্দের সঙ্গে আলপনা আঁকছি। সবাই মিলে সামান্য শ্রম দিচ্ছি। তারা বলেন, সৌন্দর্যের প্রতীক মানুষ, সুন্দরকে কে না ভালোবাসে।

সহযোগী অধ্যাপক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম করে সারাদিন আলপনা আঁকছে। যারা আলপনায় হাত বাড়িয়েছে, তারা কেউ পাকা শিল্পী নয়। তারা ভালোবাসা থেকে, ভালোলাগা থেকে এ কাজটি করছে। আলপনায় তারা যেভাবে বসন্তের আমেজ ফুটিয়ে তুলেছে তা দেখে আমি অভিভূত। আলপনা যারা আঁকছে ও সহযোগিতার করছে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল খালেক বলেন, দেশের ইতিহাস থেকে আলপনার ইতিহাস পাওয়া যায়। এছাড়া অনেক পণ্ডিতই ব্রত ও পূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলপনাকে প্রাক-আর্য সময়কার উৎপত্তি বলে চিহ্নিত করেন। তাছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও মিনার সংলগ্ন সড়কগুলোয় আলপনা করা হয়। প্রচলিত রীতির আওতার মধ্যে থেকেও অনুষ্ঠান, পটভূমি ও শৈল্পিক কারুকার্যে আলপনার রূপভেদ লক্ষ করা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় বসন্ত উপলক্ষে সবুজ চাদরে লাল বিল্ডিংয়ে মোড়ানো ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীরা সাজাচ্ছে। ক্যাম্পাসকে বিভিন্ন আলপনায় রাঙিয়ে তুলছে তারা। কলেজে চারুকলা নামে কোনো বিভাগ না থাকার পরেও শিক্ষার্থীদের এমন কাজ আমাদের বাঙালির শিল্প সাহিত্যকে গৌরবময় ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যা আমাদের গর্ব।