ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা

বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে গচ্চা যাবে ৭ কোটি ডলার!

ইসমাইল আলী: বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াট। তবে উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। অতিরিক্ত এ সক্ষমতার একটি অংশ নিয়মিতই বসে থাকছে। এছাড়া জ্বালানি সংকট বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরের বিভিন্ন সময় বন্ধ রাখতে হয়। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই গুনতে হয়। এতে মাসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গচ্চা যাচ্ছে সাত কোটি ডলারের বেশি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, গ্যাস/জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াটে মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০-১২ হাজার ডলার। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াটে মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় ২০-২৫ হাজার ডলার।

বৈঠকের তথ্যমতে, বর্তমানে পিডিবির অধীনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা (আমদানিসহ) ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল উৎপাদন করা হয় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। তবে প্রকৃত চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। স্বাভাবিকভাবে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির (পিপিএ) আওতায় গ্যাস বা তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বছরে ১০ শতাংশ সময় বন্ধ (আউটেজ) রাখার অনুমোদন রয়েছে। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরে ১৫ শতাংশ সময় বন্ধ রাখার অনুমোদন রয়েছে।

বৈঠকে আরও জানানো হয়, প্রতি কিলোওয়াট গ্যাস/জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০-১২ ডলার। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াটে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় ২০-২৫ হাজার ডলার। এতে প্রতি হাজার মেগাওয়াট গ্যাস/তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত ক্যাপাসিটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ১২-১৪.৪ কোটি ডলার। আর প্রতি হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত ক্যাপাসিটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ২৪-৩০ কোটি ডলার।

এদিকে পিডিবির তথ্যমতে, গত ১২ মে রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলোর মধ্যে পিডিবি ছাড়া বসে ছিল পাঁচ হাজার ৫৭২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাস/তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল চার হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ৯২৪ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে মোট সাত কোটি ১৯ লাখ ডলার। এর মধ্যে গ্যাস/তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ কোটি ১১ লাখ ডলার এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল দুই কোটি আট লাখ ডলার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১২ মে গ্যাস সংকটে আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ ছিল ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর জ্বালানি তেল সংকটে ডিজেল/ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল ৩০টি। এছাড়া কয়লা সংকটে বন্ধ ছিল তিনটি। এসব কেন্দ্রের মধ্যে তুলনামূলক উৎপাদন কম ছিল। দিনে পিক আওয়ারে (দুপুর ১২টা) উৎপাদন করা হয় ১১ হাজার ৭৬৪ মেগাওয়াট। আর রাতে পিক আওয়ারে (রাত ৯টা) উৎপাদন করা হয় ১৩ হাজার ৮০৬ মেগাওয়াট।

উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এসব কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই গুনতে হবে। যদিও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না তেলভিত্তিক বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে চুক্তির শর্তের কারণে বেসরকারি এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পুরোটাই দিতে হবে। এতে পিডিবির গচ্চা যাবে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।

সূত্র জানায়, ডলার সংকটে চলতি অর্থবছর বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারেনি। ফলে জ্বালানি তেল সংকটে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে আংশিক উৎপাদন হয়। এছাড়া সরকার ভর্তুকির অর্থ নিয়মিত ছাড় না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। গ্যাস সংকটেও বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা যাবে না।

তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জ্বালানি তেল সংকটের কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে ৩০-৪০ শতাংশ উৎপাদন করেছে। আর ১০ শতাংশ সময় স্বেচ্ছা বন্ধ রাখার শর্ত ছিল। অর্থাৎ বাকি ৫০-৬০ শতাংশ সময় উৎপাদন বন্ধ ছিল বেসরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের। যদিও এজন্য কেন্দ্রগুলোকে কোনো ধরনের জরিমানা করতে পারবে না পিডিবি। কারণ চুক্তিতেই এ বাড়তি সুযোগ দেয়া আছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে।

যদিও গত সেপ্টেম্বরে রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পিডিবি। তবে পিডিবির এ সিদ্ধান্তে আপত্তি জানায় বিপ্পা (বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস’ অ্যাসোসিয়েশন)। ওই সময় বিপ্পা জানায়, চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসের বিল পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। তাতে ব্যর্থ হলে মালিকরা চাইলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে পারবে। এজন্য কোনো ধরনের জরিমানা বা ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা যাবে না। বিপ্পার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয় পিডিবি।

প্রথমে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। তবে ডলার সংকট না কাটা ও ভর্তুকি নিয়মিত না পাওয়ায় এখনও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিল নিয়মিত দিতে পারছে না পিডিবি। ফলে পরে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আরও ছয় মাসের জন্য বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে ছাড় দেয়া হয়। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ের জন্যই ছাড় পাচ্ছে আইপিপি ও রেন্টালগুলো।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনায় শুধু ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জুলাই ’২২ থেকে ডিসেম্বর ’২২ পর্যন্ত অতিরিক্ত আউটেজের বিপরীতে লিকুইডেটেড ডেমারেজ না কাটা বা অ্যাভেইলেবল ফ্যাক্টর বিবেচনায় ক্যাপাসিটি চার্জ হ্রাস না করার সাময়িক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে ডলার সংকট এখনও কাটেনি। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিলও নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তাই ডেমারেজ না কাটার মেয়াদ জুন পর্যন্ত পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।