নিজস্ব প্রতিবেদক: সিগারেট খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রাজস্ব আদায়ে ২০০২-০৩ অর্থবছরে চারটি মূল্যস্তর (প্রিমিয়াম, উচ্চমান, মধ্যম মান ও নিম্নস্তর) করা হয়। সে সময় বহুজাতিক কোম্পানি প্রিমিয়াম, উচ্চমান ও মধ্যম মান এবং দেশীয় কোম্পানি নিম্নস্ল্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করত। তবে বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) ও শতভাগ দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি ছিলÑবহুজাতিক কোম্পানি কখনও নিম্নস্ল্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করবে না। এর ফলে দেশীয় সিগারেট কোম্পানির ব্যবসার প্রসার ঘটে। বর্তমানে দেশে ২৪টি দেশীয় সিগারেট কোম্পানি রয়েছে। দেশীয় কোম্পানি ব্যাংকঋণ ও মূলধন দিয়ে বিনিয়োগ করে নিম্নস্ল্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করে, যা থেকে সরকার পেয়েছে। কিন্তু বিএটি কথা রাখেনি। ২০০৬-০৭ সালের দিকে নিম্নস্ল্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করা শুরু করে।
এর ফলে দেশীয় কোম্পানি প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে সরকার শতভাগ দেশীয় কোম্পানির বিনিয়োগ সুরক্ষায় ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাজেটে দুটি মূল্যস্তর সৃষ্টি করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর দেশীয় কোম্পানির জন্য নিম্নস্ল্যাব সংরক্ষিত রেখে বহুজাতিক কোম্পানির আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডকে মধ্যমমানে উন্নীত করে। কিন্তু অজানা কারণে সরকারের নেয়া সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এর ফলে দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে। দেশীয় কোম্পানিকে বহুজাতিক কোম্পানির হাত থেকে মুক্তি দিতে সরকারের ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নেয়া সেই পদক্ষেপ আগামী ২০২২-২৩ বাজেটে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে দেশীয় মালিকানাধীন সিগারেট কোম্পানির সংগঠন লোকাল ওন্ড সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার মালিক সমিতি। গতকাল এনবিআর সম্মেলন কক্ষে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এসব সুপারিশ করা হয়। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সভাপতিত্ব করেন।
সমিতির প্রতিনিধি ইকবাল আনোয়ার ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশীয় মালিকানাধীন সিগারেট কোম্পানির জন্য সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জোর দাবি জানিয়ে বলেন, গত ১৫ বছরের মধ্যে নিম্নস্ল্যাবের সিগারেটের দাম প্রায় ৬৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি হওয়ার কারণে বতর্মানে আমরা প্রতি হাজার শলাকায় দুই হাজার ৯০০ টাকা কর দিচ্ছি, যার ফলে বাজারে নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোলের সিগারেট বেড়ে গেছে। অবৈধ পথে নকল রেভিনিউ স্ট্যাম্প আসছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা শঙ্কিত। তিনি বলেন, উচ্চমূল্যের কারণে দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির নিম্নস্ল্যাবের সিগারেটের বাজার দিন দিন কমে যাচ্ছে। দেশীয় মালিকানাধীন ২৪টি সিগারেট কোম্পানি রয়েছে, যাতে অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। দেশীয় কোম্পানির সিগারেটে কর না বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
সমিতির লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়, ২০০৬-০৬ অর্থবছর বিএটি’র নিম্নস্ল্যাব বাজার ছিল শূন্য, যাতে দেশীয় কোম্পানির বাজার ছিল শতভাগ। এর পরের অর্থবছর থেকে নিম্নস্তরের সিগারেটে দেশীয় কোম্পানির বাজার হারাতে থাকে, যাতে বাজার বাড়ে বিএটি’র। ২০১৮-১৯ অর্থবছর বিএটি’র দখলে ৫৯ শতাংশ, দেশীয় কোম্পানির ৪১ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছর বিএটি’র ৭৪ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছর ৮৪ শতাংশ দখলে চলে যায়। আর জাপান টোব্যাকোর ১৬ শতাংশ চলে যায়। আর দেশীয় কোম্পানির বাজার নেমে আসে ১০ শতাংশে। সরকার পদক্ষেপ না নিলে বহুজাতিক দুটি কোম্পানির আগ্রাসনে দেশীয় সিগারেট শিল্প পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। আগামী বাজেটে নিম্নস্ল্যাবের দেশীয় কোম্পানির প্রতি ১০ শলাকার জন্য ৩৯ টাকা এবং বিদেশি কোম্পানির জন্য প্রতি ১০ শলাকা ৪৭ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন। দুটিতে সম্পূরক শুল্ক ৫৭ টাকা করে, আর মধ্যম মান ৭৩ টাকা, উচ্চমান ১১৩ ও ১৪৮ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ টাকা করে করার প্রস্তাব করা হয়। এতে রাজস্ব আদায় ২২ শতাংশ বাড়বে বলে মনে করেন সমিতির নেতারা।
সভায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনিম বলেন, সম্প্রতি আমরা দেখছি, ট্যাক্স স্ট্যাম্প নকল করে নিয়ে আসা হচ্ছে, আমাদের পণ্যও কিছুটা নকল হচ্ছে। এ বিষয়ে এনবিআরের সহযোগিতা লাগবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, করের বড় কোনো খাত থাকলে এবং সে খাতে উচ্চ কর হলে তাদের সুরক্ষারও দরকার হয়। কারণ ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারলে ফাঁকিবাজদের লাভ। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ বিদেশ থেকে ট্যাক্স স্ট্যাম্প নকল করে আনা একটা স্পর্ধার বিষয়। স্ট্যাম্প নকল করা টাকা নকল করার সমান। আমরা চিন্তিত, কারণ ওই নকল স্ট্যাম্প আমাদের সিগারেটের ওপর লাগিয়ে বিক্রি করবে। এর দায়ভার আমাদের ওপর এসে পড়বে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিগারেট আর মদের ওপরে রাজস্বনির্ভরতা থাকবেই। এই খাতের ওপর রাজস্বের বোঝা বাড়িয়ে খাতটিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, শুধু ভ্যাট বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বরং চোরাচালানের সুযোগ তৈরি হয়। তাই আমরা প্রতিবছর তামাক কোম্পানিগুলোর বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকি।’
অপরদিকে, মোবাইল ফোন গ্রাহকদের আরও বেশি সুবিধা দিতে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর করপোরেট করসহ বিভিন্ন করের হার বাস্তবসম্মতভাবে কমানোর দাবি জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল অপারেটরস অব বাংলাদেশ (এমটব)।
এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম ফরহাদ (অব.) বলেন, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করছি।
বাংলাদেশ বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হারুনুর রশিদ খাবার পানির ওপর অর্পিত পাঁচ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান। সব ধরনের কর মিলে কোমল পানীয়র ওপর মোট ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ কর নেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করে এটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য প্রস্তাব করেন তিনি। কার্বোনেটেড বেভারেজের সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য প্রস্তাব রাখেন তিনি।