শেয়ার বিজ ডেস্ক: বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বহুমুখী সংকট ক্রমেই বাড়ছে। আসছে বছর তা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন তারা। দ্রুত সেই পথের সন্ধান মিলবে, তেমনটিও আশা করা যাচ্ছে না। খবর ইকোনমিস্ট।
অর্থনীতিবিদদের মতে, কয়েক বছর আগে শুরু হওয়া বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চলতি বছরও একই ধারায় রয়েছে। আগামী বছরও তা অব্যাহত থাকবে।
চলতি বছরের আলোচিত বেশকিছু ঘটনা বিশ্ব অর্থনীতিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশাল জয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের সরে আসার সিদ্ধান্ত বা ব্রেক্সিট বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। চীনের অর্থনীতিতে মন্দা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। বর্তমান সময়ের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ ভারতে আকস্মিক ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে দেশটির অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে তেলের দাম নিয়ে রফতানিকারক দেশগুলো গত ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি কিছুটা স্বস্তির বাতাস বইতে পারে সামনের সময়ে। এছাড়া সামনের বছরগুলোতে প্রতিটি দেশের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক খাতে সাইবার আক্রমণের বিষয়টি।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামী বছরটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য কঠিনই হতে চলেছে। এর অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শুরু নিয়ে ব্রিটেন ও ইইউ’র মধ্যে টানাপড়েন। মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের বিজয়ী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বাণিজ্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় এ চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। এছাড়া নির্বাচিত হওয়ার পর পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুপক্ষীয় কূটনীতির চেয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে, যা আবারও ঊনবিংশ শতকের আবহ সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্যাট্রিক পোর্টারের মতে, ‘আমরা অস্বস্তিকরভাবে এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় ঐতিহাসিকভাবে ‘স্বাভাবিক’ এক কূটনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আমরা একই সময় অন্য বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতা করবো।’
সাম্প্রতিককালে চীনে প্রবৃদ্ধি মন্দা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। চলতি অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই ব্যাংক সুদের হার বাড়ানো মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য প্রবল ঝুঁকি বলে মনে করেন মার্কিন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বের সব অঞ্চলের বাজারেই ভোগ্যপণ্যের দামে প্রায়ই বড় ধরনের ওঠানামা দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত শ্রেণি তাদের সীমিত আয় দিয়ে সারা মাস বহু কষ্টে দিনাযাপন করছে।
আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বের অর্থনীতির ৩ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমতে পারে, যা ২০১৭ সালে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত হবে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাশার চেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হওয়াকে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে। এছাড়া যেসব উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে বলে আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে মার্কিন অর্থনীতিবিদ ল্যারি সামারস বলেন, ‘দুষ্টচক্রে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। এ সংকট সহজে কাটবে না; পরিত্রাণ পেতে হয়তো বহু বছর লেগে যাবে।’
ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন সামারস। তিনি বলেন ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন কোনোভাবেই সুদের হার না বাড়ায়। এটি করলে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা চলছে, তা আরও প্রলম্বিত হবে। বিনিয়োগে আস্থা হারিয়ে ফেলবে শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা। এতে বিশ্ব অর্থনীতির ধস ঠেকানো যাবে না।’
সামারস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব অর্থনীতি এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে ব্যাংক ঋণ নিয়ে কোনো কিছু কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই। উদীয়মান দেশের বাজার ব্যবস্থায় ধসে পড়েছে। আর গতিশীল অর্থনীতির গতি থমকে গেছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান ওয়েন সোয়ান তার বক্তব্যের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ অলিভার ব্ল্যাংকার্ড অর্থনীতির এ টালমাটাল অবস্থার জন্য পুঁজিবাদী দেশগুলোকে দায়ী করেছেন। ফরাসি এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমি মনে করি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে শ্লথদশা ধীরে ধীরে ঘটছে। বিশেষ করে চীনে খুব ধীরগতিতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। তবে সংকট কেটে যাবে।’
আইএমএফের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হোসে ভিনালস বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে এখনও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়নি, কারণ উদীয়মান দেশ যেমন চীন, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ার বাজার ব্যবস্থা ততটা ঝুঁকিতে আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে এ কথা সত্য যে, এসব দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে।’
ভিনলসের মতে, তেল ও সোনার দামে নি¤œগামী প্রবণতা থাকায় সারা পৃথিবীর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়ত এ দুটি পণ্যের দাম কমায় অন্য ভোগ্যপণ্যের দাম কমছে।