বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঢাকার রাজপথ। ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগ ও আন্দোলনকে পৃথিবী স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাবতে ভালো লাগে, শিহরণ জাগে ভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে বিশ্ববাসী প্রতি বছর ‘একুশের দিনটি পালন করছে, পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শুরু হয়েছিল ভাষাগত বিভেদ থেকেই। বাংলার সঙ্গে বাঙালির যত আবেগ, যত ভালোবাসা, সেটি অন্য কোনো ভাষার ক্ষেত্রে তেমনভাবে আছে কি না জানা নেই। আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বছর পাঁচেক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা ভাষা প্রচলিত হয়েছিল। এ সময় বাংলা ভাষা, প্রশাসন, শিক্ষার মাধ্যম, নি¤œ আদালত প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত চালু হতে থাকে। মোটকথা, সত্তর দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছিল বাংলা ভাষা। কিন্তু বর্তমানে আমরা বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার করছি না। আমাদের প্রাণের ভাষার সঙ্গে এখন মিশে গেছে অযাচিত কিছু ভাষা ও ভঙ্গি। বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, হিন্দি চ্যানেল দেখতে দেখতে কোমলমতি বাচ্চাগুলো হিন্দিতে দেদার বকে যাচ্ছে। আর ইংরেজির অপব্যবহারের কথা তো না বলাই ভালো। আজকাল মায়েরা যেন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন তাদের চার-পাঁচ বয়সের বাচ্চাটিকে নিয়ে। কে আগে বাচ্চাকে সবার থেকে আধুনিক করে গড়ে তুলবেন, শিক্ষা দেবেন প্রাণের ভাষার বিকৃত রূপ। আধুনিকতার এই মারপ্যাঁচে পড়ে প্রাণাধিক শিশুরা মাতৃভাষা বাংলার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর সারাজীবন ফেরি করে বেড়াচ্ছে বিকৃত বাংলার অযাচিত আকৃতি। এক সময় যেখানে শিশুরা প্রথম শেখা বুলিতে ‘মা’ বলে ডাকত, সেখানে বর্তমানের শিশুরা মাকে ডাকছে ‘মাম্মি’, ‘মম’ বলে। কে জানে হয়তো এমন এক সময় আসবে, যখন মধুর ‘মা’ শব্দটি প্রায় হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে আমাদের বাংলা ভাষার অনুরাগ। গুলির আঘাতে সালাম-রফিকের গোঙানো শব্দ আমাদের স্মৃতিশক্তি থেকে মুছে যাবে চিরতরে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ফেসবুক-ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জš§ নিচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষা। রোমান হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। সেই বাংলার ধরনও আবার বড়ই বিচিত্র। ইদানীং চালু হওয়া এফএম রেডিওর বিরুদ্ধে ভাষা বিকৃতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এ জন্য গণমাধ্যমে ভাষার ব্যাপারে একটি নীতিমালা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, বিশেষ করে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে নিজস্ব সত্তা বিসর্জন দিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে হবে? এই আত্মবিনাশের পথ থেকে আমাদের ফিরে আসতেই হবে। লেখায়, বলায়, পঠনে-পাঠনে সর্বত্র বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মর্যাদার আসনে। মনে রাখতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু আমাদের নিজস্ব ব্যাপার নয়, এটি এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও।
ইমরান হোসাইন
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়