জামিল আহমদ: বাকস্বাধীনতা হচ্ছে স্বতন্ত্র্য ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের নির্ভয়ে,বিনা প্রহরতায় বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যতা ব্যতিরেকে নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার সমর্থিত মুলনীতি। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ মূলনীতি অনুসরণ করছে না, অর্থ্যাৎ তারা বাক-স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করছেন না। বাকস্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি যেসব স্থান,পরিবেশ বা দেশে হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের সরকার পরিচালনা করছে আওয়ামীলীগ নামক বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দেশটির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা দলটির সভাপতি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন রয়েছেন। বিরোধী দল,ভিন্ন মত ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে কঠোর নীতি অবলম্বনের কারণে শেখ হাসিনা ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাঁর সমালোচক এবং বিরোধীরা তাঁকে ‘একনায়কতন্ত্রের প্রবক্তা’ মনে করেন। বিশেষ করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধ,সাংবাদিক নির্যাতন,সাংবাদিক গুম ও খুনের ঘটনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা সর্বত্র। মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’র (র্যাব) কয়েকজন কর্মকর্তার উপর যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
আওয়ামীলীগের চলমান শাসনামলে অনেক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন,অনেক সাংবাদিক হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন,অনেক প্রিন্ট, ইলিকট্রনিক্স এবং অনলাইন মিডিয়া বন্ধ হয়েছে।
‘আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক)’ নামক একটি মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে খুন হয়েছেন ৩৫ জন সাংবাদিক। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আহত, হত্যা, নির্যাতন মিলিয়ে মোট হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২২৬ জন। এর মধ্যে আওয়ামীলীগ নির্যাতন করেছে ৩৮৩ জন সাংবাদিককে। পুলিশ ১৩০ জনকে, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছেন ২৪০ জন। একটি ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার হয়নি।
আসক আরো বলছে; চলতি বছর (২০২৩ সালের) জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে প্রায় ১১৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হয়েছেন।
২০১৩ সালে দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, চ্যানেল ওয়ান, সিএসবি এবং একসঙ্গে ৩৫টি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
হামলা,মামলা এবং নির্যাতন নিপীড়নে অতিষ্ট হয়ে বাংলাদেশের অনেক প্রতিথযষা ও খ্যাতনামা সাংবাদিক নির্বাসিত জীবনকে বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, কলাম লেখক পিনাকী ভট্রাচার্জ্য, সাংবাদিক কনক সারোয়ার ও ইলিয়াস হোসেন।
বাংলাদেশের সাংবাদিক নির্যাতন ও সংবাদপত্র দমনের বিষয়টি দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও বেশ সমালোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ যা এখন ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামক সাংবাদিক নিগ্রহের কালোআইন আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার বিষয়ক এক বার্ষিক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের বাক স্বাধীনতা হরনের বিষয়টি এসেছে। মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকার অনেক ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার “উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা” রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০২০ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত ৩০শে মার্চ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে-তাতে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে এটা অনুধাবন করা যায় যে,বাংলাদেশে অনেকটাই সীমাবদ্ধ। দিন দিন দেশটির বাকস্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে। দেশটির গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা ঝুঁকিপূর্ণ সময় পার করছেন।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক
[মতামত লেখকের নিজস্ব। শেয়ার বিজ কড়চার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে]