বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ করের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী?

ড. মতিউর রহমান: যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বিশ্ব বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের বিশাল অর্থনীতি ও বাণিজ্যনীতি বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণে সক্ষম। তবে সাম্প্র্রতিক বছরগুলোয়  যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি কিছুটা সুরক্ষা বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে, যেখানে দেশীয় শিল্প ও শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে চীনসহ অন্যান্য দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপের মতো ঘটনা ঘটছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এবং এ কারণে মার্কিন ভোক্তাদের চাহিদা ও আমদানি নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলে। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা পায়নি, যা দেশটির পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমাতে পারে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা। এই শুল্ক আরোপ শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকেই নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করতে পারে। এমন সময়ে এ ঘটনা ঘটল, যখন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সুবিধা হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ রপ্তানিকারকদের জন্য বড় সংকট তৈরি করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপের পেছনে কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। উন্নত দেশগুলো প্রায়ই তাদের অভ্যন্তরীণ শিল্প ও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কঠোর শুল্কনীতি গ্রহণ করে থাকে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আসা সস্তা পণ্য সীমিত করা, যাতে স্থানীয় উৎপাদকরা টিকে থাকতে পারে। এছাড়া নির্বাচন ঘনিয়ে এলে শ্রমিক সংগঠন ও শিল্পপতিদের চাপ বাড়ে, ফলে সরকার জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য প্রায়ই বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প, যাদের উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকদের মজুরি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম, সহজেই যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা বাণিজ্য নীতির লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।

শ্রম অধিকার, শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ এখনও জিএসপি ফিরে পায়নি। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র এই সুবিধা বাতিল করে দেয়। যদিও বাংলাদেশ শ্রমিক নিরাপত্তা ও কারখানা পরিদর্শনে উন্নতি করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তা পুরোপুরি গ্রহণ করেনি। উপরন্তু শ্রমিক ইউনিয়নের স্বাধীনতা এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সরকারি বিধিনিষেধ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা-বিষয়ক উদ্বেগও এই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে বলে মনে করা হয়।

ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্যযুদ্ধ বর্তমানে একটি নতুন বাস্তবতা। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দ্বন্দ্ব অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর কৌশলগত চাপ প্রয়োগ করেন। বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হওয়ায় এবং চীনা বিনিয়োগ গ্রহণ করায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে এই শুল্ক আরোপের পেছনে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

সুতরাং এই শুল্ক আরোপ একটি জটিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত পরিস্থিতির প্রতিফলন, যেখানে শ্রমনীতি, মানবাধিকার, ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতি সবই জড়িত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত রপ্তানিনির্ভর, যেখানে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে, যেখানে কটন ও সিনথেটিক উভয় ধরনের পোশাক তৈরি হয়। এই শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক সরাসরি কাজ করে, যাদের বেশিরভাগই নারী। চামড়াজাত পণ্য, বিশেষ করে জুতা ও ব্যাগও রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কিছু আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে না পারার কারণে এই খাত এখনও পুরোপুরি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি। অন্যান্য খাতের মধ্যে হস্তশিল্প, পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষিপণ্যও রপ্তানিতে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে।

মার্কিন বাজারে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে। এই খাত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় করে। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম, তাই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে এই খাতের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। এছাড়া চামড়াজাত পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়লে এই খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ওষুধ ও হস্তশিল্প খাত আপাতত কম ঝুঁকিতে থাকলেও ভবিষ্যতে শুল্কের পরিধি বাড়ানো হলে সেগুলোও ক্ষতির শিকার হতে পারে।

মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অন্যতম সুবিধা হলো সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করা। তবে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো ও কিছু আফ্রিকান দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে, যাদের বাংলাদেশের তুলনায় ভালো বাণিজ্য চুক্তি ও শুল্ক সুবিধা রয়েছে। তাই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পর বাংলাদেশি পোশাকের দাম বাড়লে মার্কিন ক্রেতারা অন্য দেশে ঝুঁকতে পারেন। এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের প্রধান খাতগুলো হুমকির মুখে পড়বে, যা রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। আগে যে পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কম দামে বিক্রি করা যেত, তা এখন শুল্কের কারণে ক্রেতাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাই ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশ দ্রুত বাজার দখল করে নিতে পারে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের লাভের পরিমাণ অনেক কমে যেতে পারে। আগে যেখানে ৮ থেকে ১২ শতাংশ লাভ করা যেত, এখন তা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি, এমনকি লোকসানও গুনতে হতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির শর্ত বদলাতে হতে পারে, অর্ডার বাতিল হতে পারে বা ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে রপ্তানি বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে এবং সরবরাহ চুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু মার্কিন ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের বাজার হারানোর কারণ হতে পারে। ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে, কারণ তারা প্রায় সবাই মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরশীল।

এই সংকটের কারণে শ্রমবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তৈরি পোশাকশিল্পে ছাঁটাই শুরু হতে পারে, উৎপাদন কম হওয়ায় শ্রমিকদের ছুটি দেয়া হতে পারে বা বেতন কমিয়ে দেয়া হতে পারে। কিছু কারখানায় ওভারটাইম বন্ধ করে দেয়ায় শ্রমিকদের আয় কমে যাবে। এর ফলে শ্রমিক অসন্তোষ, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে কারখানানির্ভর পরিবারগুলোয়। ৩৭ শতাংশ শুল্ক শুধু রপ্তানিকারক বা পণ্যের দামের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শিল্প খাতে আস্থার অভাব তৈরি করছে এবং কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমিয়ে দেবে, যার প্রভাব ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে রপ্তানি খাত ও অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে। এর প্রধান প্রভাব হলো রপ্তানি খাতে আস্থার অভাব তৈরি হওয়া। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের শিল্প পরিবেশ, নীতি ও বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ কম দামে ভালো মানের পোশাক সরবরাহ করে আসছিল, কিন্তু শুল্ক বাড়ার কারণে এখন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরাও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করছেন বা পুরোনো প্রকল্প বন্ধ করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রধান শক্তি ছিল কম মজুরিতে উৎপাদন ও পশ্চিমা বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার, যা এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বিনিয়োগকারীরা ভিয়েতনাম বা অন্যান্য দেশে ঝুঁকছেন, যা কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য ক্ষতিকর।

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত। এই খাতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হলে দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্য থাকবে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম হলে আমদানি ও ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া রপ্তানি খাত দুর্বল হয়ে গেলে ব্যাংকিং, ট্যাক্স ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও সমস্যা তৈরি হবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিতে পারে।

বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথেও এটি বড় বাধা হতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করলেও এই ধরনের শুল্ক সমস্যা উন্নয়নের গতি কমিয়ে দিতে পারে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে শুধু আয় বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, বরং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, বাণিজ্য ও শিল্পায়নের উন্নতি ঘটাতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক থাকলে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে, কারণ রপ্তানি খাতের উন্নতিই এর প্রধান চালিকাশক্তি। এই শুল্কের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক হিসাবে নয়, বরং শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত, যা দ্রুত সমাধান করা না গেলে উন্নয়নে বড় বাধা তৈরি করবে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উচিত দ্রুত কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছে, যদিও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছে, কিন্তু কিছু অভিযোগের কারণে তা এখনও পাওয়া যায়নি। শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। তাই বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া, প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয় করা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহানুভূতি অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা। এ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় এই শুল্ককে ‘বৈষম্যমূলক’ হিসেবে তুলে ধরা উচিত।

কূটনৈতিক চাপের পাশাপাশি বিকল্প বাজার খুঁজে বের করাও এখন জরুরি। বাংলাদেশকে তার রপ্তানি খাতকে বহুমুখী করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারের ওপর নির্ভরশীল, যা এখন সমস্যা তৈরি করছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো নতুন বাজারগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এসব অঞ্চলে বাজার সম্প্রসারণের জন্য স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি এবং বিপণন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়ানোও একটি ভালো উপায় হতে পারে। চীন, রাশিয়া, ভারত, তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন এবং বিদ্যমান সুবিধাগুলোর সঠিক ব্যবহার করা উচিত। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক), বিমসটেক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করেও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক ও বাণিজ্য বাড়ানো যেতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশীয় শিল্পের মানোন্নয়ন ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়ানো। শুধু কম মজুরির ওপর নির্ভর করে আর প্রতিযোগিতা করা যাবে না। এখন প্রয়োজন স্মার্ট উৎপাদন, ডিজিটাল মার্কেটিং ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পণ্য তৈরি করা। এর মাধ্যমে মার্কিন বাজারের বাইরেও নিজেদের একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরি করা সম্ভব হবে। এই কূটনৈতিক ও নীতিগত পদক্ষেপগুলো সময়মতো নিতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে পারবে এবং ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হবে।

বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ শুল্ক একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রথমত, মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে। একইসঙ্গে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রম অধিকার ও অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ যে উন্নতি করেছে, তা আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কূটনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহায়তায় বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে সমস্যা আসবে, তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার। পণ্য ও বাজারের বহুমুখীকরণ এবং মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি ও রপ্তানি করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। উন্নত বিশ্বে প্রতিযোগিতা করতে হলে অশুল্ক বাধা, পরিবেশগত শর্ত ও উৎপাদন প্রক্রিয়াগত মান পূরণ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এজন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন, যেখানে বাণিজ্যবান্ধব নীতি ও দক্ষতা বাড়ানোর কৌশল থাকবে। রপ্তানিকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে কিছু খাতে ভর্তুকি, করছাড় ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তি স্থানান্তর, আধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ও উন্নত প্যাকেজিং ও লজিস্টিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারের পরিবর্তন দ্রুত বিশ্লেষণের জন্য একটি শক্তিশালী ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন সেল গঠন করতে হবে।

দীর্ঘ মেয়াদে একটি টেকসই বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দেশের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ, ই-কমার্সে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক ধারণা তৈরি করতে সরকার ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-বিষয়ক ইনকিউবেশন প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে, যা তাদের নতুন বাজারে প্রবেশ করতে এবং ব্র্যান্ডিং করতে সাহায্য করবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে এই সংকট বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। ইতিহাসেও দেখা গেছে, সংকট অনেক সময় পরিবর্তনের শুরু নিয়ে আসে। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি এবং বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা।

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিঃসন্দেহে রপ্তানি খাতের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত, যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই দ্রুত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা, জিএসপি সুবিধা পুনরুদ্ধার, বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা এবং রপ্তানিকে বহুমুখী করার ওপর জোর দিতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে নতুন ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাণিজ্যনীতি, আর্থিক প্রণোদনা, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য একটি বহুমাত্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। এই পরিকল্পনায় রপ্তানি খাতের আধুনিকীকরণ, উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাণিজ্যের অস্থিরতা মোকাবিলায় ভবিষ্যৎমুখী প্রস্তুতি নিতে হবে। এই সংকটকে সুযোগে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন দৃঢ়তা, দ্রুততা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সময়মতো পদক্ষেপ নেয়াই পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে এবং নতুন পথের সন্ধান দিতে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী