শেখ আবু তালেব ও জয়নাল আবেদিন: নেপাল ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড (এনবিবিএল)’। দেশের সরকারি-বেসরকারি মালিকানার আইএফআইসি ব্যাংকের মালিকানা রয়েছে ‘নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে’। সম্প্রতি আইএফআইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার। এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এক আবেগঘন চিঠি দিয়েছেন নেপাল-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি এল বি শ্রেষ্ঠা।
নেপালের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সেই চিঠি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয় ঘুরে সেই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
নেপাল সরকার ও বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান হয় ‘নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড (এনবিবিএল)’। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক নামেই নেপালে পরিচিত। ১৯৯৪ সালের ৬ জুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। এনবিবিএল ইনভেস্টমেন্ট ও এনবিবিএল সিকিউরিটিজ নামে ব্যাংকটির দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রয়েছে।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংক। ব্যাংকটিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা রয়েছে ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি বছর মিলিয়ন ডলারের লভ্যাংশ পাচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক, যা রেমিট্যান্স হিসেবে আসছে দেশে। সম্প্রতি নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকের মালিকানা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। গত ১৩ জুলাই আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এনবিবিএলে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে ওই অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। শেয়ারের প্রত্যাশিত দাম, ক্রেতার সঙ্গে সন্তোষজনক চুক্তি, আর দুই দেশের সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনক্রমে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় নেপাল ও বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে এ-সংক্রান্ত ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।
যদিও লাভজনক খাত হলেও এনবিবিএল থেকে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সরিয়ে নেয়ার জন্য একটি চক্র উঠে পড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন এলবি শ্রেষ্ঠা।
নেপাল বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এলবি শ্রেষ্ঠা এ প্রসঙ্গে চিঠিতে উল্লেখ করেন, নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কের অন্যতম নিদর্শন নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ অবস্থায় নেপাল থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হলে নেপালের সাধারণ জনগণের হৃদয় ভেঙে যাবে। এছাড়া নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম জড়িত। বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হলে ব্যাংকটি থেকে বাংলাদেশের নাম মুছে যাবে। নেপালের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা এটা চান না।
তিনি আরও বলেন, সার্কের বর্তমান সভাপতি নেপাল। সার্কের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতি সার্কের সব সদস্য রাষ্ট্রের অন্যরকম ভালোবাসা রয়েছে। বিনিয়োগ প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না। বরং এখানে যে বিনিয়োগ রয়েছে, এর চেয়ে বেশি অর্থ প্রতি বছর দান করে বাংলাদেশ। তাই বিনিয়োগ প্রত্যাহার না করাই উত্তম।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের প্রশংসা করে চিঠিতে এলবি শ্রেষ্ঠা বলেন, সম্প্রতি সোমালিয়া, সুদান ও শ্রীলঙ্কাকে ঋণ সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু শ্রীলঙ্কাকেই ২৫ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, এটি বিশ্বব্যাপী প্রমাণ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী। এছাড়া নেপাল-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, যা সম্প্রতি বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেপাল প্রতি বছর সার, ইলেকট্রনিক পণ্য, মোড়কজাত খাবার, বিস্কুট, কাগজসহ নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে থাকে। অপরদিকে নেপাল থেকে চিনি, মসুর ডাল, রেলওয়ের সিøপার আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নেপাল-বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হচ্ছে। এর সুফল হলো নেপাল-বাংলাদেশের মধ্যে স্থলপথে যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-নেপাল-ভারতের মধ্যে মোটরযান চলাচলের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ নিতে বাংলাদেশ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এটি বাংলাদেশ-নেপাল সম্পর্কের জন্য একটি মাইলফলক। এর মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও বেগবান হবে।
চিঠির ভাষ্যমতে, একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, নেপালের ব্যাংক খাতে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে নেপাল সরকার ও দেশের জনগণ উচ্ছ্বসিত আনন্দে রয়েছে। স্থানীয় জনগণ ব্যাংকটিকে বাংলাদেশ ব্যাংক নামেই ডাকে। ব্যাংকটিতে নেপালের নাম থাকলেও তা উচ্চারিত হয় না। এর পূর্বে নেপালের ব্যাংক খাতে ভারত ও পাকিস্তানের বিনিয়োগ ছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে নেপাল-বাংলাদেশ চেম্বারের জোর প্রচেষ্টায় নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশ হিসেবে ব্যাংকটির লাইসেন্স পেতেও ভূমিকা রেখেছে।
ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ও নেপালকে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে। বর্তমানে ব্যাংকের ১০০ শাখা রয়েছে বিভিন্ন শহর ও গ্রামে। পাঁচ লাখের বেশি গ্রাহক রয়েছে। ব্যাংকটি বর্তমানে খুবই ভালো করছে। লাভজনক একটি ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএফআইসি। আমরা মনে করছি, বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়াটা আর্থিক দিক দিয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নয়। বর্তমানে এনবিবিএলের শেয়ারের দাম বাড়ছে। আগামী বছরের দিকেই শেয়ারের বাজার মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
এছাড়া নেপাল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিলে স্থানীয় জনগণ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে বাজে ধারণা জš§াবে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করবে। এটা নেপালের সাধারণ জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের প্রতি অনাস্থা তৈরি করবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সক্ষমতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের জš§ দেবে। এমন অবস্থায় আমরা আবেদন করছি, শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য।
এ বিষয়ে জানতে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম সারওয়ারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মোবাইল ফোনে কল দেয়ার পাশাপাশি এসএমএস পাঠানো হয়। কিন্তু গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (রাত ১০টা) তিনি কোনো উত্তর দেননি।
প্রসঙ্গত, নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৫ সালে নেপাল স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এ ব্যাংকের মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ কোটি ৪৮ হাজার ২১২টি। ব্যাংকের ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ারের মালিক আইএফআইসি ব্যাংক, সংখ্যায় যা তিন কোটি ৬৮ লাখ ২৭ হাজার ৪২৬টি।