Print Date & Time : 12 August 2025 Tuesday 10:48 pm

বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব এক শতাংশের কম

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ধরনের জলযান নির্মাণ ও রফতানি বাণিজ্য হয় বছরে এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশ এক শতাংশ ছোট জাহাজের কার্যাদেশ পায় চার বিলিয়ন ডলারের, যা বিশ্ববাজার অংশীদারিত্বে এক শতাংশের কম। অথচ সবচেয়ে সস্তা শ্রমবাজার ও প্রতিযোগীদের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম খরচে নির্মাণ সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। এক্ষেত্রে দেশের শিপইয়ার্ড খাতকে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা ও নীতিগত সহায়তা দেওয়া গেলে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) সর্বশেষ তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে বছরে বিভিন্ন ধরনের জলযান নির্মাণ ও রফতানি বাণিজ্য হয় এক হাজার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশের এক শতাংশ ছোট জাহাজের কার্যাদেশ পায় চার বিলিয়ন ডলার, যা টাকার হিসেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ কার্যাদেশগুলো দেশের মোট ১৩০টি কোম্পানি একক কিংবা যৌথভাবে বাস্তবায়ন করে।

জাহাজ নির্মাণ শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, শিল্প উদ্যোক্তারা এলসিটি, সার্ভে জাহাজ, টাগ বোট, কনটেইনার ভেসেল, অয়েল ট্যাংকার, কার্গো ভেসেল, বাল্ক ক্যারিয়ার, ফিসিং ট্রলার, অফসোর পেট্রল ভেসেল, বার্জ, এলএনজি টার্মিনাল, ওয়ার্ক বোট, প্যাসেঞ্জার ভেসেল, প্যাসেঞ্জার ফেরি, ড্রেজার নির্মাণসহ অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরিতেও সক্ষম। এ খাতের ২০টি কোম্পানি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ রফতানি করছে।

বাংলাদেশ ‘শিপবিল্ডিং নেশন’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিশ্বের অন্যান্য প্রতিযোগীর তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে। আর স্বল্প খরচে এবং আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক জাহাজ ও জলযান নির্মাণ সক্ষমতায় দক্ষ। আর রফতানিও করেছে বিশ্বের ১৫টিরও অধিক দেশে। কিন্তু এ অগ্রযাত্রাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের শিপইয়ার্ড যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ভিশন ২০২১ ও ভিশন ২০৪১ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে। এক্ষেত্রে দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে জাহাজ আমদানি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে নীতিমালার বাস্তবায়ন জরুরি। কারণ গুণগত মান বজায় রেখে কম খরচে সব ধরনের জাহাজ নির্মাণের দক্ষতা আমাদের আছে। আর দেশীয় উদ্যোক্তারা স্বল্প খরচে এবং আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণসহ বিক্রয়-পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি এ খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রণোদনার নীতিমালা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এতে করে জাহাজ নির্মাতার আরও বেশি জাহাজ নির্মাণে উৎসাহিত হবে। তা না হলে জাহাজ আমদানিতে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা বলেন, কিছু ব্যবসায়ী বিদেশে ব্যবহার করা জাহাজ আমদানির মাধ্যমে এ শিল্পের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার পাঁয়তারা করছেন, যা বাস্তবায়িত হলে দেশি শিল্পের বিকাশ ও বিকাশমান অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে। তাছাড়া এসব সম্ভাব্য আমদানিতব্য ব্যবহৃত জাহাজ স্বল্প কর্মঘণ্টা ও স্বল্প-জীবনচক্রের হবে। এছাড়া জাহাজে থাকা উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা মানুষের শরীরে মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজম্মের জন্য হুমকি। আর অর্থ পাচারের আশঙ্কা তো আছেই।

জাহাজ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, চীন, কোরিয়া, জাপান ও ভারতের জাহাজ নির্মাতারা তাদের মূলধনি বিনিয়োগে সরকারের কাছ থেকে অত্যন্ত স্বল্প সুদে ও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ সুবিধাসহ ভর্তুকি ও বিশেষ রফতানি সুবিধা লাভ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে অবকাঠামোগত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের অধিক হারের সুদ এবং স্বল্প সময়ে পরিশোধের শর্তের কারণে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো আশানুরূপ এগিয়ে যেতে পারছে না। দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, পঞ্চদশ শতক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে কাঠের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মূল কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। এখানকার নির্মাতারা সপ্তদশ শতকে তুরস্কের সুলতানের জন্য পুরো ফ্লিট তৈরি করেছিল। আর মোগল আমলে বাংলা জাহাজ ও নৌকা তৈরির কাজে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পায়। সেই স্বীকৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারাবাহিতভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।