Print Date & Time : 2 August 2025 Saturday 5:19 pm

বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে মেগা প্রকল্প

মোস্তফা কে. মুজেরী: দক্ষ মানবশ্রম ছাড়া যেমন প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ফলাফল অর্জন করা যায় না, তেমনি আধুনিক অবকাঠামো ছাড়া একটি দেশের সর্বাত্মক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুপরিকল্পিত অবকাঠামোর উপস্থিতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গতি আনতে পারে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং আর্থ-সামাজিক সুযোগ ও নতুন নতুন অর্থনৈতিক কার্যক্রম সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের বর্তমান স্তরে দ্রুত অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি হচ্ছে লজিস্টিকস ব্যয় হ্রাস করার জন্য মাল্টি-মোডাল সংযোগের বিকাশ এবং অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য অবকাঠামোর উন্নয়ন। এটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, কারণ এ ধরনের কৌশল গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই চেইন এবং লজিস্টিকসের ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ সংস্কার সাধন করবে। মৌলিক অবকাঠামোর উন্নয়ন বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার উন্নতিও ঘটাবে, উচ্চ মূল্য সংযোজনকারী উৎপাদনকে উৎসাহিত করবে এবং দেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতির আধুনিকায়নে সহায়তা করবে।

একটি শক্তিশালী সংযোগ কাঠামো শুধু অন্তঃআঞ্চলিক ও আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যকে শক্তিশালী করে না, বরং উচ্চ আয় ও সমৃদ্ধিও সৃষ্টি করে। বর্ধিত সংযোগ উচ্চ দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাণিজ্য সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন সংযোগ ব্যবস্থা পরিবহন ও রসদ খরচ কমিয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে।

আমরা যদি আধুনিক বিশ্বের উন্নয়নের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিই, তাহলে অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে যে, কীভাবে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প (যেগুলো মেগা প্রকল্প নামে পরিচিত) লাখ লাখ দীর্ঘবঞ্চিত মানুষের জীবনে রূপান্তরমূলক প্রভাব আনার মাধ্যমে ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠতে পারে। এই প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার চালক হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি দ্রুত ক্রান্তিকালীন অর্থনীতিতে।

এখন বাংলাদেশের প্রয়োজন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে সংযুক্ত করার জন্য এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্কের পরিপ্রেক্ষিতে ভালো সড়ক অবকাঠামো। আমরা যদি অন্যান্য দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচির দিকে দৃষ্টি দিই, তবে এটা দেখা যেতে পারে যে, এই দেশগুলো এখন আগে বাস্তবায়িত সুপরিকল্পিত সড়ক অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর সুবিধা ভোগ করছে। একইভাবে এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করার ভিত্তি স্থাপন। বিশ্বব্যাপী হোটেলের মতো ‘স্টার’ ধারণা নিয়ে রাস্তার মতো যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সুপার হাইওয়ে, ফ্রিওয়ে, মোটরওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে প্রভৃতি অর্থনীতির বিভিন্ন চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছে।

তবে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের চাবিকাঠি হচ্ছে উচ্চমানের অবকাঠামো বিনিয়োগের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয়া, যেখানে পরিকাঠামো প্রকল্পগুলোর দ্বারা কতটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্য সৃষ্টি করা যেতে পারে, তার ওপর নির্ভর করে গুণমান পরিমাপ করা হয়। উচ্চমানের অবকাঠামো উচ্চ স্পিল-ওভার প্রভাব সৃষ্টি করবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর রাজস্ব বৃদ্ধিতেও প্রতিফলিত হবে। অধিকন্তু মানসম্পন্ন অবকাঠামো নির্মাণ বলতে কেবল ভৌত অবকাঠামো বোঝায় না, বরং সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সঠিক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো স্থাপন এবং কার্যকর শাসন কাঠামোকেও বোঝায়।

যদিও সাম্প্রতিক কিছু মেগা প্রকল্প (যেমন পদ্মা সেতু) পরিচালনায় বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প উল্লেখ করার মতো, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই ধরনের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের বিচক্ষণতা। এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে পরীক্ষা করা উচিত Ñ বৃহৎ অবকাঠামো বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত কতটা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিগ্রাহ্য হবে?

এই ধরনের যেকোনো প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে, এটি একটি সমৃদ্ধ ও টেকসই ভবিষ্যতের বীজ রোপণ করতে পারে। একই সঙ্গে বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নত করে এবং একটি ফলপ্রসূ ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে সক্ষম হবে। সেই সঙ্গে এসব মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রেকর্ড প্রদর্শন করে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে বাংলাদেশকে আরও দ্রুত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ সফল হবে।

এজন্য এসব মেগা প্রকল্পের মৌলিক লক্ষ্য হতে হবে নতুন ব্যবসায়িক দিগন্ত উম্মোচনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক চেহারায় পরিবর্তন আনা, যা উন্নয়নের ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করবে। পরিবহন নেটওয়ার্ককে শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সুলভ এবং নিয়মিত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে; দ্রুত বন্দর পরিষেবা ও সমন্বিত সংযোগ সুবিধার মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে সহায়তা প্রদান করতে হবে। এসব সম্ভাবনা উপলব্ধি করার জন্য বাস্তব সুবিধা, যেমন লজিস্টিকস সহায়তা ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের মতো অ-মূর্ত সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক বিনিয়োগের গন্তব্য সৃষ্টি করতে এসব মেগা প্রকল্পকে লিভার হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে। সঠিকভাবে পরিচালিত হলে এসব মেগা প্রকল্প সফলভাবে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ঘাটতি, পরিবহন সংকট এবং অন্যান্য ঘাটতি টেকসইভাবে পূরণ করবে।

প্রত্যাশিত সুবিধা অর্জন করার ক্ষেত্রে এই ধরনের মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য প্রযোজ্য তথাকথিত লৌহ আইন, যা হচ্ছে বারংবার ব্যয় বৃদ্ধি, ঘনঘন সময় ওভাররান প্রভৃতি, যা ‘মেগা অবকাঠামো প্রকল্প প্যারাডক্স’ নামে পরিচিত, তা প্রশমিত করার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে এ-জাতীয় প্রকল্পগুলোর প্রভাব সম্পর্কে দুটি বিপরীতমুখী মতামতের অস্তিত্ব উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি মতবাদ মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর সমালোচনা করে এগুলোর আর্থিক কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবেশগত অবনতি এবং বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির অতিরিক্ত বোঝার বিষয়ে অভিযোগ করে। অপর মতবাদ এই ধরনের প্রকল্পগুলোকে সমর্থন করে এই যুক্তিতে যে, সরকার সাধারণত এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের আগে ব্যাপক সম্ভাব্যতা যাচাই করে।

স্পষ্টতই বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বিনিয়োগের হটস্পটে পরিণত করার জন্য কৌশলগতভাবে নির্বাচিত এবং আর্থ-সামাজিকভাবে কার্যকর ও লাভজনক বৃহৎ অবকাঠামোগত মেগা প্রকল্প প্রয়োজন। পূর্ব এশিয়ার টাইগাররা তাদের বিকাশের প্রথম দিকে জনসাধারণের কাছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পণ্য সরবরাহ করার জন্য গ্রাউন্ড ব্রেকিং মেগা প্রকল্পগুলোয় প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল। প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয় গতিবেগ সৃষ্টি করতে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক রূপান্তরের বিস্ময়কর সাফল্যের জন্য পূর্ব এশিয়ার পথের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশের উচিত হবে, এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া, যেমন কীভাবে সর্বোত্তম ফলাফল অর্জন করা যায়। সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব মেগা প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণ এবং মূলধন সঞ্চয়ের জন্য রাজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন করে অর্থনৈতিক গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে। মেগা প্রকল্পের মতো কাঠামোগতভাবে রূপান্তরকারী প্রকল্প অর্থনীতির সামাজিক কাঠামো এবং ল্যান্ডস্কেপে উন্নয়নমুখী রূপান্তর আনতেও সক্ষম হবে।

তবে এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বারংবার ব্যয় বৃদ্ধি মোকাবিলা করা, বাস্তবায়নে দুর্বলতা এড়াতে লাল-ফিতার প্রতিকার করা, যাতে প্রকল্প সময়মতো শেষ করা যায় এবং তহবিলের অব্যবস্থাপনা রোধ করা যায়। সাধারণত এসব প্রকল্প অতি-জটিলতা, অতি-আশাবাদ এবং দুর্বল বাস্তবায়নের শিকার হয়, যার সমাধান করাও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এটিও উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ যে, মেগা প্রকল্প সব অবকাঠামোগত ঘাটতির প্রতিষেধক নয়। অনেক নরম (ংড়ভঃ) অবকাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে, যা দক্ষ ও কার্যকর অবকাঠামো পরিষেবাগুলোকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তোলে।

সামগ্রিকভাবে এ ধরনের প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই ও বাস্তবায়নের সময় ‘ব্যয় অবমূল্যায়ন এবং সুবিধার অতিরিক্ত মূল্যায়ন’ সিনড্রোম কীভাবে এড়ানো যায়, তা নিশ্চিত করা সরকারেরই দায়িত্ব। স্থানীয় ও বিদেশি উভয় পরামর্শদাতাদের প্রবণতা হচ্ছে মেগা প্রকল্পের একটি ‘বিকৃত’ (ফরংঃড়ৎঃবফ) সামগ্রিক চিত্র প্রদান করা, যা প্রকল্পটি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে কার্যকর কি না, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পরিস্থিতিকে অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর করে তোলে।

এই কারণে কাগজে বা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সবচেয়ে ভালো এমন নয়, বরং বাস্তবে সেরা প্রকল্পটি বেছে নেয়া এবং বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি বর্তমান সময়ে যখন বাংলাদেশ অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং ভবিষ্যতে এরকম আরও মেগা প্রকল্প গ্রহণ করবে, তখন বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি ভৌগোলিক অঞ্চল কীভাবে মেগা প্রকল্প উন্নয়নের ‘বাজার প্রভাবকে’ আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে? শিল্প কাঠামো সর্বোত্তম ও উন্নয়ন গতিবেগ ত্বরান্বিত করার সবচেয়ে অনুকূল ও সেরা পন্থা কী? কীভাবে উচ্চগতি এবং উচ্চমানের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা যায় এবং এ ধরনের আরও কিছু বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যা বর্তমানে দ্রুত কাঠামোগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেÑএসব প্রশ্নই গভীর বিবেচনার যোগ্য।

নির্বাহী পরিচালক

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স

অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)

ও সাবেক মহাপরিচালক

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)