বাংলাদেশের উন্নতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স বলতে বোঝায় বিদেশে কর্মরত কোনো নাগরিক যখন দেশে অর্থ পাঠায়। অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও উন্নত জীবনযাপনের আশায় মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। এসব প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্স একটা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয় এবং মোট জিডিপিও বৃদ্ধি পায়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে।

প্রবাসীরা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। করোনা মহামারির কারণে রেমিট্যান্স কমে যাবে বলে ধারণা করা হলেও তা হয়নি। এর কারণ হলো অতিমারির ফলে অবৈধ পথে অর্থ প্রেরণ বাধাগ্রস্ত হয়, যার  ফলে প্রবাসীদের ব্যাংক মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি।

মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ প্রবাসী কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে সৌদি আরবে। সেখানে তাদের সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, জর্ডান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা কাজ করছেন। তবে মানতেই হয়, তাদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক থেকে অদক্ষ ও স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকের সংখ্যাই অনেক বেশি।

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৩৭ লাখ ডলার, যা ২০০০ সালে বেড়ে পৌঁছে ১৯৫ কোটি ডলারে। বর্তমানে তা দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপি’তে রেমিট্যান্সের অবদান ছয় শতাংশেরও বেশি। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সংকটমুক্ত করতে ভূমিকা রেখেছিল রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্সের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনেক বেড়েছে।

প্রবাসীরা বাংলাদেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হুন্ডিকে প্রাধান্য দেয়। হুন্ডি হলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ব্যক্তিগত পর্যায়ের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ পাঠানোর মাধ্যম। ২০০৬ সালে গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টের (জিইপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পাঠানো প্রবাসী অর্থের ৫৬ ভাগই আসে হুন্ডির মাধ্যমে। তাই আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহারের জন্য সরকার এখন ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়া অতীতের তুলনায় সহজ করার ফলে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

চার বছর ধরেই দেশে বাড়ছিল রেমিট্যান্সের পরিমাণ। এমনকি রেকর্ডসংখ্যক কর্মীও প্রবাসে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে প্রবাসী আয় না বেড়ে বরঞ্চ আগের তুলনায় কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর একটি বড় কারণ হলো, বৈধ পথে আয় পাঠাতে খরচ বেশি হয়। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে (হুন্ডি) আয় পাঠালে প্রতি ডলারে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি দেয়া লাগে, যার কারণে অনেকে টাকা পাঠানোর মাধ্যম হিসেবে হুন্ডি বেছে নিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং করেন।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববাজারে শ্রমিকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রবাসী আয় আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। সরকার প্রবাসী আয়ে প্রণোদনার পরিমাণ আরও বাড়াতে পারে। এটি অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ পাঠানো কমাতে সাহায্য করবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশীয় শ্রমিকের বড় একটি অংশ যেহেতু অদক্ষ, তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। তাহলে দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হবে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। সরকার রেমিট্যান্স খাতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাতকে আরও প্রসারিত করতে পারবে।

রাফিহা বিনতে মিজান

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়